সব কিছুর একটা শেষ আছে৷ সুন্দর যে রাস্তা সেটাও কোথাও না কোথাও গিয়ে শেষ হয়। চিরকালই কোনো কিছু একরকম থাকে না। কোনো সম্পর্ক, কোনো সুন্দর দিন, কোনো সুন্দর মুহুর্ত শুধু তাৎখনিকভাবেই সুন্দর। অভ্যস্থ হয়ে গেলে সুন্দর কিছুকে আসলেই কি আলাদা করে আর সুন্দর মনে হয়?
রাতের জাহাজে দুইরকম মানুষ থাকে। একদল হলো যাত্রী। যারা সমুদ্রের বিশালতায় মুগ্ধ হয়। আরেকদল সেই জাহাজেই কাজ করে। তারা কোনো কোনো দিন সমুদ্রের বিশালতায় নিঃসঙ্গবোধ করে। দিনের পর দিন নীল সমুদ্রে থাকতে থাকতে তাদের কি মুগ্ধ হবার ক্ষমতা কিছুটা লোপ পায় না?
অনুভূতির বিকার ঘটবেই। সম্পর্কের শুরুর দিকে মানুষ যতটা আকুল থাকে, একনজর মানুষটাকে দেখার জন্য যতটা ব্যাকুল হয়, সম্পর্কের গভীর পর্যায়ে মানুষ ততটাই উদাসীন হয়ে যায়। কারণ, তখন মানুষটা হারিয়ে যেতে পারে এই ভয়টা ফিকে হয়ে যায়। অথচ, অন্য পাশেরজন আগের মতো গুরুত্ব পায় না বলে, ধীরে ধীরে বিষাদগ্রস্থ হয়ে যায়, সে খবর পায় না এই পাশের জন। মানুষের ভালবাসা, শোক, দুঃখ - সব অনুভূতিই সময়ের সাথে বদলায়।
সবচাইতে ট্র্যাজেডি কি জানেন, একটা মানুষ মরার পরই আর মানুষ থাকে না, মৃত্যুর পরের মুহুর্তেই তার নাম হয়ে যায় লাশ। আবার, একটা লাশও ছয়মাস পরে আর লাশ থাকে না৷ মাটিতে মিশে যায়। তাই বদলে যাওয়াটা অনিবার্য নিয়ম। যা কিছু আজ আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি, কাল এগুলো একরকম থাকবে না। আমি পাল্টাব, তুমি পাল্টাবে। আমাদের চারপাশটা বদলাবে। রঙ কি শুধু গিরগিটিই বদলায়?
পৃথিবীর সবাই রঙ বদলায়। দুইটা মানুষের সাথে আলাদা করে কথা বলতে গেলেও তো আমরা দুইরকম ভাবে কথা বলি। একেকজন মানুষের জন্য আমাদের মস্তিষ্ক একেকরকম ট্রিটমেন্ট রেডি করে নেয় অবস্থা বুঝে। সেই ট্রিটমেন্টও বদলায়। আজ যে নোবডি, কাল সে বিরাট কিছু হলে তার প্রতি মনোভাবও বদলে যায়। সংসারে যে ছেলেটা এতদিন বেকার, সে হঠাত চাকরি পেলে তার প্রতি আচরণ বদলে যায়। যে মানুষটা তার দূর্বলতা প্রকাশ করে ফেলে তার জন্য একরকম আচরণ দেখাই আমরা, যার প্রতি আমরা দূর্বল তার প্রতি আরেকরকম। তাহলে চিরস্থায়ী বলতে কি আছে! কিছুই নেই।
পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর, সব পরিবর্তনের একটা রুপ। অনেক কষ্টে অর্জন করা একটা সাফল্য, সারাজীবনের সাফল্য না। একটা দুঃখকে অনেকদিন পুষে রাখা যায়, সুখের দিনকে বেশিদিন ধরে রাখা যায় না। কারণ, যখনই মনে হবে, জীবনে ভাল কিছু হতে যাচ্ছে তখনই সেখান থেকেই নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়ে যারা ভাবে জীবন খুব বদলে যাবে, একটা চাকরি পেলেই যারা আশা করে জীবন ঠিকঠাক হয়ে যাবে, আর কোনো সমস্যা থাকবে না - তারা জানে না এই ছোটখাট আরাধ্য মুহুর্ত থেকে জীবনের আরো বিবিধ জটিলতার সূত্রপাত হয়। জীবন এভাবেই কাজ করে আসলে। সবসময়ই আপনাকে কিছু না কিছু সেক্রিফাইজ করে যেতেই হবে।
প্রত্যেকটা জীবন অপূর্ণ, অপ্রাপ্তি আর কিছু প্রাপ্য না পাওয়ার হতাশায় ঘেরা। আপনি যখন নিজের পরিবারকে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিবেন, আপনাকে শুধু একারণেই অন্যদিকে অনেক কিছু ছেড়ে আসতে হবে। যে প্রেমের জন্য দিনের পর দিন একজনের পেছনে ঘুরে বেড়াবেন, সে প্রেম হয়ে যাওয়ার পর খেয়াল করবেন অন্যদিক দিয়ে মহাগুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু আপনি হারিয়ে বসে আছেন, যা আর ফিরে পাবার উপায় নেই। যারা শৈশব থেকে খুব এটা সেটা জানে, প্রোগ্রামিং শিখে, আরো বিভিন্ন অসাধারণ কাজ করে তার জন্য সে হয়ত একদিন অনেক বড় রিওয়ার্ড পাবে, কিন্তু সাধারণ শৈশবের আনন্দ থেকে সে বঞ্চিত হবে।
এসব পরিস্থিতি যে মানুষ খুব জেনেশুনে বেছে নেয় তাও নয়, জীবনই তাকে একভাবে না একভাবে গন্তব্যে টেনে নিয়ে যায়। খুব কম মানুষই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারে। 'মাই লাইফ, মাই রুলস' বলে যতটা এটিচিউড শো করি আমি, তুমি- তাতে কি যায় আসে। জীবনের কাছে আমরা কত অসহায় সেটা নিজের সাথে বোঝাপড়া করলে খুব বেশিরকম টের পাওয়া যায়। এজন্যেই হয়ত, অনেক প্রাপ্তির ভীড়েও কিছু শূণ্যস্থান থেকেই যায়, অনিয়ন্ত্রিত কিছু অনুভূতিই প্রকট হয়ে মধ্যরাতের নিদ্রাহীনতার কারণ হয়। একারণেই, জীবনকে ঘিরে অদ্ভুত একটা শূণ্যতা থাকে, একটা অস্পষ্টতা থাকে।
ইদানিং আত্মহত্যাও বেড়ে গেছে। এবছর শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরই কয়েকটা সুইসাইডের খবর শুনেছি। অনেকে বলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও কেন সুইসাইড করলো, কি ভীষণ বোকা৷ কেউ বলে ইহকালেও কিছু পেল না, পরকালেও কিছু পাবে না, কি ভীষণ বোকা। আমি এসব দেখেশুনে হাসি। মানুষ কি নিজের মুখোমুখি হতে পায়? অন্যের জীবন নিয়ে যারা জাজমেন্ট করেই যাচ্ছে প্রতিনিয়ত আমি নিশ্চিত, খুবই নিশ্চিত এরা কেউ সুখে নেই। এদেরও জীবনটা অনেক সমস্যায় জর্জরিত। একবার নিজের ভেতরটার দিকে ওরা তাকাক, শুকিয়ে যাচ্ছে সব আশার নদী, ভাঙ্গণ ধরে আছে ওখানে, অনেক রকমের ক্ষত। তারা তাকাতে ভয় পায় হয়ত।
প্রত্যেকটা স্বপ্নের সাথে মানুষের কিছু স্বপ্ন এবং কাল্পনিক চিত্রপট মনে আঁকা থাকে। ধরুন, যে ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, তার মনে এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অনেক সুন্দর সুন্দর কিছু দৃশ্যপট তৈরি থাকে। সে কল্পনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে কি কি পাল্টে যাবে, প্রাপ্তির খাতায় কি কি যোগ হবে। সে নিশ্চয়ই একটা ভাল টিউশন পাবে, অনার্স শেষের আগেই চাকরির একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে, অনেক ভাল কিছু বন্ধুদের দল পাবে, এমন শিক্ষকদের ক্লাস করবে যে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতেই থাকবে।
কল্পনার সাথে বাস্তবতার তফাত আকাশ পাতাল। সবক্ষেত্রেই এমন। আমরা যখন মন খারাপের কথা বলি, মনের গভীরে কল্পনা করি এমন কারো কথা, সে মন খারাপের কথা শুনলেই আমাদের মন খারাপ কেটে যেত। কেউ একা মানেই একা না, একা বলতে সে ফিরে যায় তার কল্পনায়, যেখানে এমন কাউকে এঁকে রেখেছে যাকে ছাড়া সে একা। আমার কিছু ভাল লাগছে না, এই কথা শুনার পর একশজন এসে সহানুভূতি দিলেই আমাদের ভাল লাগা ফিরে আসে না। আমরা কিছু নির্দিষ্ট মানুষের মুখ থেকেই শুনতে চাই, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
তাই, কেউ ডিপ্রেশনে থাকলে আমরা যখন তাদের জ্ঞ্যান দেই, মন খারাপ করো না, সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করে না। আমরা কারো সমস্যারই পুরোপুরি গভীরে গিয়ে বুঝতে পারি না। কল্পনা দিয়ে আমরা সমস্যার যে সহজ সমাধান বলে ফেলি, ব্যাপারগুলো এমন নয়। সমাধান সব মানুষই জানে। তবুও, কেন এত সমস্যা নিয়ে ঘুরে মানুষ?
দূর থেকে অনেক কিছুই সহজ মনে হয়। কিন্তু, এত সহজ নয় কিছুই। সহজ যদি হতো, আইয়ুব বাচ্চু ডিপ্রেশনে থাকতেন না, চেস্টার বেনিংটন আত্মহত্যা করতেন না, রবিন উইলিয়ামস যে নিজে ইনসপিরেশনাল কথা শুনাত সিনেমায়, সে নিজেই বাস্তবে আত্মহত্যা করতে যেত না। আমাদের কল্পনা, আর বাস্তবে অনেক ব্যবধান। কল্পনার সুন্দর, বাস্তবের সুন্দর এক না আসলে। একটা উক্তি অনেকেই শেয়ার দেয়, তাদের প্রিয় উক্তি। Hope is a good thing, may be the best. আমার এই উক্তিটা পছন্দ হয় না। আশাবাদ এক ধরণের কল্পনা। ইলিউশন। কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা আসলে করা উচিত না, অপেক্ষার ফলাফল খুব হার্টব্রেকিং হয়। কারণ, অপেক্ষার সাথে 'এক্সপেকটেশন'ও জড়িত। মানুষের যাবতীয় সমস্যার মূলে গেলে দেখা যায়, অতিরিক্ত এক্সপেকটেশনই তাকে সমস্যা থেকে বের হতে দিচ্ছে না।
এক্সপেকটেশন কম রাখাই ভাল, সব কিছু ঠিকঠাক চলবে, সুন্দর থাকবে এমন তো হয় না। তাছাড়া, সব সুন্দরের সাথে সবসময়ই একটু নির্মমতা লুকিয়ে থাকে, যেটা ধরা যায় না স্বাভাবিক নিয়মে। আনন্দের আতিশয্যে আমরা বলি, কি ভয়ংকর সুন্দর! না বুঝেই মানুষ কখনো কখনো ঠিক বলে। এটা ওরকমই কিছুটা। সুন্দর মানেই ভয়ংকর, সেটা যা-ই হোক। একটু একটু করে গড়া সব কিছুই তিলে তিলে ব্যাকফায়ার করবে, কারো কিছুই করার থাকে না। কেউ কোনো কিছু রেখে দিতে পারে না। কেউ কোনো কিছু বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। এটাই স্বাভাবিক। কোনো কিছুর আবেদন কখনো একরকম থাকে না। একটা চমৎকার গানও বার বার শুনতে শুনতে বাসি হয়ে যায়, মানুষ আর এমন কি!