বাবার প্রস্থান!

in BDCommunity3 years ago

পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে তাদের মধ্যে মানুষ নবজাতক হিসেবে অনেক বেশি দুর্বল থাকে। একজন মানুষ জন্ম নেয়ার পর পরই সে হাতি শাবকের ন্যায় ঘুরে বেরাতে পারে না। সে পারে না মুরগির ছানার মতো নিজের খাবার নিজে খুঁজে খুটিয়ে খুটিয়ে খেতে কিংবা ডলফিন শাবকের মতো সাঁতরে বেড়াতে। এতো কিছুর পরেও সেই নবজাতক কিন্তু সবচেয়ে বেশি নিরাপদে থাকে। তার কারণ কি? কারণটা হচ্ছে, তার বাবা মা ছায়ার মতো থাকেন সবসময়। ছোট থেকে বড় করার সকল দায়িত্ব নিয়ে নেন বাবা মা। এই বাবা মা, অন্যান্য পশু পাখির মতো সন্তান কিছুটা বড় হলেই সন্তানকে দূরে সরিয়ে দেন না। সন্তান যত বড়ই হোক না কেন বাবা মার কাছে সে আজীবন ছোট সন্তানই থেকে যায়। নিজের সর্বস্ব দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখার যে চেষ্টা তারা করেন তা অন্যান্য প্রাণির মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না।

বাবা মা জিনিসটাই এমন। সন্তান বড় করার জন্য, পৃথিবীতে তার একটি সুনির্দিষ্ট এবং সুনিশ্চিত অবস্থান তৈরি করার জন্য সব বাবা মার যে অনন্ত চেষ্টা তা পৃথিবীর কোন শক্তিই দমাতে পারে না। বাচ্চার রাতের ঘুমটা যেন ভালো হয় তার জন্য রাতের রাতের পর রাত জেগে থাকতে পারেন তারা। বাচ্চা একটু বড় হওয়ার পর তার খেলনার আবদার মেটানোর সব বাবা মাই নিজেদের ইচ্ছার বলি দিতে রাজি। সন্তানের ভালো ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, সামর্থ্য অনুযায়ী সন্তানকে ভালো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেয়ার চেষ্টা করেন তারা। ঈদ বা পূজা-পার্বন যাই থাকুক না কেন, সব বাবা মা আগে সন্তানের চাহিদা পূরণের কথা আগে ভাবেন। সন্তানের জন্য পছন্দ ও সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো পোশাক কেনার পরই তারা নিজেদের কথা ভাবেন।

এতো গেলো ছোটবেলার কথা। আমরা আজ যারা বড় হয়েছি, আমাদের ক্ষেত্রেও কি আমাদের বাবা মার দৃষ্টিভঙ্গি কোন পরিবর্তন হয়েছে? সারাদিন শেষে যখন বাসায় ফিরি মার প্রথম কথাই থাকে সারাদিন কিছু খেয়েছি কিনা? অনেক সময় তো তারা অনেক রাত পর্যন্ত সন্তানের সাথে খাওয়ার জন্য নিজেরা না খেয়ে অপেক্ষা করেন। তবে এটা ঠিক অনেক বাবা মা বিশেষ করে বাবারা ক্ষেত্র বিশেষে একটু শক্ত মনের হয়ে থাকেন। তবে বাবাদের এই শক্ত হওয়ার পেছনের কারণটা হচ্ছে সন্তান যেন জীবনে তাড়াতাড়ি নিজের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারেন। অনেক বাবাতো নিজের সর্বস্বটা দিয়ে দিতেও প্রস্তুত থাকেন সন্তানের জন্য। অনেক বাবার হয়তো নিজের তেমন সামর্থ্য থাকে না, তবে সেই বাবাও কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছে সন্তানের জন্য সবচেয়ে বেশি দোয়া করেন। এই জন্য একজন সন্তানের কাছে তার বাবা মা একটা বট গাছের মতো। প্রখর রোদ হোক কিংবা ভয়ানক ঝড়, এই বট গাছের নিচে আসলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায় একজন সন্তানের জন্য।

আজকে আমি আমার বাবাকে নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি, যাকে মহান আল্লাহ তায়ালা, গত ২২ শে ফেব্রুয়ারি তাঁর কাছে নিয়ে গেছেন। আমার বাবা এখন কবরের বাসিন্দা। বিশ্বাস করতেও খুব কষ্ট হয় যে, আমার বাবার অস্তিত্ব শেষ হয়ে গেছে এই পৃথিবীতে। পরকালে ইনশাআল্লাহ ভালো আছেন এবং ভালো থাকবেন দোয়া করি সবসময়।

সেই ২২ শে ফেব্রুয়ারির পর অনেক দিন হয়ে গেছে কিছু লিখি নি। লিখবো কি করে, আমার জীবনের সকল কাজের অনুপ্রেরণা, সবচেয়ে বড় উৎসাহদাতা ছিলেন আমার বাবা। যাই করি না কেন, আমার বাবা বিশ্বাস করতেন যে আমি ভালো কিছু করবো। সেই বাবাই যখন নেই তখন কোন কাজ করতে গেলেই মাথা ধরে আসে। লিখতে গেলে হাতগুলোতে যেন এক অদৃশ্য শিকল বেঁধে দেয় কেউ। তবে যখনই আমার বাবার হাসিমুখটা সামনে চলে আসে, মনে হয় বাবা হয়তো আমার পাশেই আছেন। আমাকে বলছেন, "কাজে নেমে পড়ো বাবা। আমি তো আছি।" সত্যি বাবা হয়তো আছেন আমার পাশে। আমার বিশ্বাস তিনি সবসময় আমার পাশে থাকবেন।

বাবা চলে যাওয়ার দিনটায় আমি বাবার সাথেই ছিলাম। আমি জীবনে কখনো সামনে থেকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে দেখিনি এর আগে। সেদিন দেখিছিলাম। আমার বাবা হয়তো আমাকে আরো বেশি শক্ত হওয়ার জন্যই ঐ দিনটাকে বেছে নিয়েছিলেন। তবে ঐ মুহুর্তটা ভুলতে পারা আমার জন্য সবচেয়ে বেশি কঠিন।

২২.০২.২০২২। একটু ভালো করে দেখলে বোঝা যায় এই তারিখটার একটা বিশেষত্ব আছে। এরকম সংখ্যা গুলো কে প্যালিন্ড্রোম সংখ্যা বলা হয়। আয়নার সামনে ধরলে সামনে পেছনে একই রকম দেখাবে এই সংখ্যাগুলো। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এরকম প্যালিন্ড্রোম তারিখ এসেছিল আজ থেকে প্রায় এগারোশ বছর আগে এবং তা ছিল ১১.০১.১০১১। এরকম তারিখ আবার আসবে আরো প্রায় এগারোশ বছর পর। আগের দিন রাতে বড় বোনের সাথে এই নাম্বার নিয়ে কথা বলছিলাম। ২২ তারিখ আমার খুব কাছের এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল। আপুকে বলছিলাম যে বন্ধুটি কতো সৌভাগ্যবান যে এই শতাব্দীতে এরকম শুধুমাত্র ওরাই এরকম তারিখে জন্মদিন উদযাপন করতে পারবে। কিন্তু আল্লাহ যে আমার পরিবারের জন্য এই দিনটি চিরদিনের জন্য স্বরনীয় করে রাখার বন্দোবস্ত করে রেখেছেন তা তখন কে জানতো। সকাল ৮ টার দিকে বাবা চলে যান আমাদের ছেড়ে। হয়তো এই পৃথিবী আর ভালো লাগছিল না তাঁর। তাইতো বাবার এতো চলে যাবার তাড়া। চলে গেলেন। রেখে গেলেন অসীম ভালোবাসা আর পরম মমতার কিছু স্মৃতি।

পরিবারে আমার বাবা ছিলেন সবচেয়ে বেশি শান্ত মেজাজের মানুষ। তাঁর কাছ থেকেই আমার যেকোন পরিস্থিতিতে শান্ত থাকার শেখা। আমার এতোটুকু বড় হওয়ার জীবন যাত্রায় আমি অনেক বেশি করেও মনে করার চেষ্টা করেও পারিনি যেদিন আমার বাবা শাসন করতে যেয়ে আমার গায়ে হাত তুলেছিলেন। হ্যাঁ, বোকা হয়তো দিয়েছিলেন কিন্তু তা কখনোই মাত্রাতিরিক্ত ছিল না। অনেক সময় দেখা যায় ছোটদের শাসন করতে যেয়ে আমরা এমন কিছু বলে ফেলি যা তাদের মনে সাড়া জীবনের জন্য দাগ ফেলে দেয়৷ তখন আসলে কাজের চেয়ে উল্টোটাই বেশি হয়। আমার ক্ষেত্রে হতো ঠিক তার অন্যরকম। ছোটবেলায় বাবা যদি কখনো আমাকে একটা কড়া কথা বলতেন তখন আসলেই মনে হতো যে, বাবা যেহেতু আজ আমাকে এই কথা বলেছেন তাহলে নিশ্চয় কষ্ট পেয়েছেন এবং আমাকে বাবার কথা শুনতেই হবে। বড় হওয়ার পরেও একই রকম ছিল ঘটনাগুলো। যদিও আমার বাবা খুবই কম আমার উপর রাগ করতেন।

বাবা ছিলেন আমার বন্ধুর মতো। ছোটবেলায় আমার যখন ক্রিকেট ম্যাচ থাকতো বন্ধুদের সাথে তখন প্রতিদিন খোঁজ নিতেন আজকে কেমন খেললাম। তবে বাবাকে বলা হয়ে ওঠেনি শেষ ম্যাচ কেমন খেলেছিলাম। বলার সুযোগ দেননি বাবা।

বাসায় আমরা প্রায়ই লুডু খেলতাম। আমার মা আর অন্য কেউ থাকতো এক টিমে আর আমি আর বাবা থাকতাম এক টিমে। কারণ বাবার কথা ছিল, আমরা খেলবো খুব শান্তশিষ্ট ভাবে। আর তার কথামতো ঠান্ডা মাথায় খেলে আমরা প্রায় প্রতিটি ম্যাচ জিতেও যেতাম। বাবা ছিলেন আমার ছক্কা মারার ভরসা। আমাদের স্ট্র‍্যাটিজি ছিল অনেকটা এরকম, বাবা ভালো দান মারবেন আর আমি গুটি চালবো। ভালো দান তোলার ক্ষেত্রে আমি বাবার উপরেই নির্ভরশীল ছিলাম। তাঁর ভাগ্যটাই ছিল এমন। ভালো দান আমাদের মধ্যে বাবারই বেশি উঠতো। আর যখন আম্মুর কোন গুটি খেতাম তখন আম্মুর রাগ আর বাবার পান খাওয়ার দাগ পড়া সেই কি হাসি। হাসতে হাসতে কাশি চলে আসতো বাবার। আর কখনো এমন টিমম্যাট পাবো না আমি! হয়তো লুডু খেলায় ওই মজাটাও পাবো না আর।

আমার মনে পড়ে, তখনো আমি স্কুলে ভর্তি হইনি। পাড়ার এক মক্তবে আরবী পড়তে যেতাম ছোট আপুর সাথে। বাবার কর্মস্থল ছিল সেই মসজিদের কাছেই। তো বাবা একদিন দুপুরের পর মসজিদের সামনে দিয়ে ফিটফাট হয়ে যাচ্ছিলেন। হাতে ছিল কিছু রেজিস্ট্রার বুক। ছোটবেলায় মনে হতো শুধুমাত্র স্কুলে যারা পড়ে তারাই শার্ট ইন করে পড়ে। তাই আমার বাচ্চা মন ভেবেছিল যে, বাবা হয়তো স্কুলে যাচ্ছে পড়তে। তো বাবাকে যখন বলেছিলাম যে আমি তাকে স্কুলে যেতে দেখেছি, তখন তাঁর হাসি থামায় কে? এইতো চলে যাওয়ার কিছুদিন আগেও এই নিয়ে বাবা ছেলের মধ্যে অনেক খুনসুটি চলেছিল।

ছোটবেলায় বাবা মজা করে বলতেন আমাকে আগারগাঁও থেকে পেয়ে এনেছেন তিনি। বাবা জানতেন আমি কথাটা শুনলে কাঁদবো। বাবা বলতেন আর আমিও বোকার মতো কাঁদতাম। বাবা তখন হাসতেন আর আম্মুর বকা খেতেন আমাকে কাঁদানোর জন্য। অবশ্য বড় হওয়ার পর ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরতে দেরী হলে যখন বাবা কারণ জিজ্ঞেস করতেন তখন আমিও বলতাম আগারগাঁও গিয়েছিলাম আমার আসল আব্বুকে খুঁজতে। বাবার হাসি থামায় কে তখন। মাঝে মাঝে হাসতে গিয়ে কাশি উঠে যেত দেখে শেষের দিকে আমরা প্রায়ই বাবাকে হাসতে মানা করতাম। কি করবো কষ্ট হতো তখন।

আজও বাবার সেই হাসি দেখার খুব ইচ্ছে হয়। মনে হয় বাবা হুট করে চলে আসুক আর আমি জড়িয়ে ধরে কাঁদি। এতে বাবার যত ইচ্ছা হয় তিনি হাসুক। কেউ থামাতে আসবে না বাবাকে। সেই হাসিটা আর দেখবো না বাবার। কিন্তু আমার ছেলের মতো বাবাটাকে খুব দরকার। এখন অনেকদিন হলো বাবা নামটা আর ফোনে ভেসে ওঠে না। কাজের জন্য শেষ কিছুদিন আলাদা ছিলাম। একটা দিনও এমন যায়নি যেদিন বাবা ফোন দেননি। মাঝে মাঝে দিনে এতোবার ফোন দিতেন যে বিরক্ত হয়ে বলতাম এতো ফোন দিলে কাজ করবো কিভাবে। আর এখন বাবা কল দেন না। বাসায় ফিরতে দেরী হলেও খোঁজ নেননা।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার যে যাত্রা তাতে একমাত্র বাবাকে বন্ধুর মতো পেয়েছিলাম। একমাত্র তাঁর বিশ্বাস ছিল আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবো। বন্ধুর মতো ঐ সময়টায় পাশে ছিলেন বাবা। একমাত্র বাবার কাছেই আমি নির্দ্বিধায় আমার সব শেয়ার করতাম। সেই সময়টা বাবার সাপোর্ট না পেলে আমি কখনো এই পর্যায়ে আসতে পারতাম। এরকম বন্ধুর মতো হয়ে আর পাশে থাকবেন না বাবা। তবে বাবার কিছু স্বপ্ন ছিল আমাকে নিয়ে, আমাদের নিয়ে। আজ হয়তো বাবা নেই, তবে আমি বাবার সেই স্বপ্ন গুলো পূরণ করবো ইনশাআল্লাহ।

আমি জানি যে আমরা কেউই চিরদিন পৃথিবীতে থাকবোনা। আমার বন্ধুদেরকেও আমি এটা বলতাম যে, আমাদের আগে আমাদের বাবা মার চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। হ্যাঁ, এটাই চিরন্তন সত্য। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী আমাদের বাবা-মারাই আমাদের আগে চলে যেতে হয়। বাবাও সেই নিয়ম মেনেই চলে গিয়েছেন। বাবা বেঁচে থাকতে সবসময় আমাকে একজন শান্ত, সৎ এবং ভালো মানুষ হওয়ার জন্য শিখিয়েছেন। চলে যাওয়ার পরেও শিখিয়েছেন কিভাবে অন্যদের জন্য নিজেকে শক্ত হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। তবে হঠাৎ এতো বেশি শক্ত থাকার অভিনয় করতে হবে তা বুঝে উঠতে পারিনি। কেউ পারে না হয়তো। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাকে কবুল করে নিন, বাবার জন্য এই দোয়াটাই করি এখন সবসময়।

IMG_20220310_134013.jpg

Sort:  

কিছু কিছু চিরন্তন সত্য মেনে নেওয়া খুবই কঠিন।
আল্লাহ ওনাকে জান্নাত নসিব করুক এবং ওনার দেখিয়ে যাওয়া আদর্শ ও স্বপ্নগুলো আপনি পূরন করতে পারেন সেই দোয়া করি।

Glad to see you back!

দোয়া করবেন ভাই। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শের সঠিক সম্মান বজায় রাখার।
দোয়া করি আপনাদের সবার পরিবারের সকলকে আল্লাহ সুস্থ রাখুন।

আমীন।

You post has been manually curated by BDVoter Team! To know more about us join our Discord.


Delegate HIVE POWER to us & earn HIVE daily.

FOLLOW OUR HIVE AUTO CURATION TRAIL

মৃত্যু মানেই অস্তিত্ব শেষ নয়। বাবার আদর্শ ধরে রাখা মানেই বাবার অস্তিত্ব। বেশি বেশি বাবার জন্য দান করুন। মহান আল্লাহ সকল বাবাকে ভালো রাখুক। আমার বাবা সহ পৃথিবীর সকল বাবাকে আল্লাহ জন্নাতুল ফিরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করুন।

Congratulations @abmamun! You received a personal badge!

Happy Hive Birthday! You are on the Hive blockchain for 2 years!

You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking

Support the HiveBuzz project. Vote for our proposal!