ভোর ছয়টা থেকে বৃষ্টি হচ্ছে আজ। চায়ের কাপে চুমু দিতেই মনে পরল ৬৭ বছর হয়ে গেছে আমার। কি পেলাম বা কি হারালাম এই ৬৭ বছর জীবনে। মনে পড়তেই নিজের অজানাতেই এসব অতীতের হিসেব মাপার খাতা খুললাম।
আমার জন্ম মাদারীপুরের মাটিভাঙ্গা গ্ৰামে। জন্ম থেকে অভাবে বড় হওয়া আমার। কিন্তু ছোট থেকেই পণ করেছিলাম যে একদিন আমার নিজের বাড়ি গাড়ি হবে। আমি আমার পরিবারের মতো গরিব হয়ে জীবন কাটাবো না। তাই যখন আমার ভাই বোন রা খেলায় ব্যস্ত থাকতো, তখন আমি মনোযোগ দিতাম পড়াশোনায়। গ্রামের ছোট্ট স্কুলে পড়লেও আমার রেজাল্ট বরাবরি ভালো হতো। এভাবেই ধীরে ধীরে আমি এগিয়ে যেতে শুরু করি ।তারপর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য ঢাকায় আসি। হ্যাঁ,ভাগ্য এখানেও আমাকে সাড়া দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই। এর মাঝে আবার জীবনে প্রেমও আসে। যদিও মেয়েটি আমার মত গরিব পরিবার থেকে আসেনি,তবুও আমাদের ভালোবাসা এসব প্রতিকূলতা জয় করে। তখন তো আর বর্তমানের মত মোবাইল ফোন ছিল না। তাই তখন মানুষ কম রোবট ছিল। এখন তো আমার মানুষকে মানুষরূপী রোবট মনে হয়।সারাদিন হাতে মোবাইল। সামনের মানুষের কি হল কোন হুশ নেই কিন্তু নিউজ ফিডে কখন কি আসে সেদিকে তাদের বড্ড বেশি মনোযোগ।
যাই হোক গ্র্যাজুয়েশন শেষে খুব ভালো চাকরি হয়ে যায় আমার। ভাবলাম এবার তো বিয়ের সময়। কিন্তু আমার গরিব পরিবার দেখে ওর পরিবার আমার সাথে বিয়ে মানতে পারেনি। বরং অনেক উঁচু বংশের এক পরিবারের ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক করে। তারপর এক দিনের মাথায় প্ল্যান করে ও বাসা থেকে বের হয়ে যায় আমার হাত ধরে। আমরা বিয়ে করে নিই। তারপর থেকে ওর পরিবার ওর সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেয়। মেয়েটি আমার জন্য ওর পরিচয় পরিবার সব ছেড়ে আমার কাছে চলে আসে। বিয়ের পর তাই ওকে আদর করে আমি ডাকতাম রানু। বিয়ের পর ভালো বেতনের চাকরি এবং রানুকে নিয়ে খুব সুখী ভাবে জীবন যাপন যাচ্ছিল। তারপর আমাদের ঘর আলোকিত করে আসে আমার একমাত্র মেয়ে আদর। তখন মনে হতো আমার থেকে সুখী হয় তো এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কিন্তু কে জানত ভাগ্য বেশিদিন আমার সহায় হবে না। মেয়ের যখন ৫ বছর বয়স তখনই রানু আমাকে আর আমার মেয়েকে ছেড়ে পরপারে চলে যায়। আমার একমাত্র আদরের মেয়েটা মা হারা হয়। যদিও ও তখন তেমন কিছু বুঝেনা। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করিনি। সব সময় মেয়েকে নিয়ে থাকতাম। ছোট থেকেই মেয়েটাকে মায়ের অভাব কখনো অনুভব করতে দেইনি। কোন অভাব রাখেনি। মেয়েটিও কখনো আমার কথার অবাধ্য হয়নি। দেখতে দেখতে আমার ছোট মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেল। ভার্সিটিতে উঠলো। একা চলাচল করা শিখে গেল। এখন আর তার সবকিছুকে বাবাকে প্রয়োজন হয় না। আমিও আমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এই মহান উক্তিটি আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার মেয়ে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তার জীবনেও প্রেম আসতে পারে। বয়স বাড়ার কারণে আমি একটু জলদি ঘুমিয়ে পড়তাম সবসময়। একদিন হুট করে রাত বারোটার সময় ঘুম ভেঙে যায়। পানি খেতে রুমের বাইরে আসতেই আদরের রুম থেকে কথা বলার শব্দ পেলাম। এত রাতে আমার মেয়ে কার সাথে কথা বলছে?! কৌতূহল বসত আদরের রুমের দরজার বাইরে আসলাম। আমার বুঝতে আর বাকি রইল না আদর এত রাতে কার সাথে কথা বলছে। প্রচন্ড রাগে নিজের ঘরে ফেরত গেলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এই আমার মেয়ে! যে মেয়েকে আমি নিজের হাতে নম্র ভদ্র করে বড় করেছি,সেই আমার মেয়ে কিনা এখন প্রেম করছে! তখন মনে পড়ল মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। উল্টাপাল্টা কোন ছেলের সাথে সামনে আগানোর চেয়ে ওর বিয়ে এখন দিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। যেই ভাবা সেই কাজ। পরের দিন থেকে আমি ছেলের খোঁজ শুরু করলাম। আমার এক বন্ধু পাভেল, তার পরিচিত এক বিত্তমান পরিবারের ছেলের সম্বন্ধ নিয়ে আমার কাছে আসলো। ছেলের নাম জিহাদ। পেশায় বিজনেসম্যান। টাকার কোন অভাব নেই। বাড়ি গাড়ি জমি সবই আছে। আর মেয়ে হিসেবে আমার আদরের মতো একজন মেয়েই জীবনে চায়। ভদ্র ও সংসারী। আমার জিহাদকে সাথে সাথে পছন্দ হয়ে যায়। এই ছেলেই আমার মেয়েকে আজীবন সুখে রাখবে। ছেলের পরিবারের সাথে তারপর কথা বললাম। তারপর বাসায় ডাকলাম। আদরকে যদিও কিছু জানাইনি কারন আমি জানি আমার মেয়ে আমার কথার উপরে কথা বলবেনা। অন্তত এই বিশ্বাস আমার আদরের প্রতি ছিল। তো আমি উনাদের আসতে বলি ঠিক যে সময় আদর ভার্সিটি থেকে বাসায় আসবে। উনারা আসলেন, ঠিক কিছুক্ষণ পরেই আদরও বাসায় চলে আসলো। আদর প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি। তারপর যখন আমি আদরকে বাকি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম তখন ও সব বুঝতে পারলো। মেয়েটার মুখের হাসি মুহূর্তেই হারিয়ে গেল। যদিও এটা তখন আমার দেখার বিষয় ছিল না। কারণ আমি পুরনো দিনের মানুষ। আমি একটা জিনিসই বুঝি অথবা বুঝতাম , একবার বিয়ে হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। মেহমানরা সবাই চলে যাওয়ার পর আদরের সাথে আমার প্রথম কথা কাটাকাটি হয়। ও আমাকে সাফ জানিয়ে দেয় ও এ বিয়ে করতে পারবে না। ও নাকি একজন ছেলেকে ভালোবাসে চার বছর ধরে। ওই ছেলের সাথে তার সম্পর্ক। ছেলে ওরই ক্লাসমেট! আমার মাথায় রাগ তখন তিনগুণ বেড়ে যায়। একে তো মেয়ে প্রেম করেছে, যেটা আমি কোনদিন ওর থেকে আশা করিনি। তারপর ছেলেটা তার ক্লাসমেট! এত বড় বোকা মেয়ে আমি কবে বড় করলাম! এই শিক্ষা পেল আমার মেয়ে আমার কাছ থেকে এত বছর ধরে! কিন্তু আমিও হাল ছাড়ার পাত্র নই। আমি পরদিন থেকে মেয়েকে ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দেই। মেয়ের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিই। অবাক করার বিষয় হল তারপরও ও কিভাবে যেন সে ছেলেটির সাথে যোগাযোগ করতে পারত।
একদিন সন্ধ্যায় ছেলেটি বাসায় আসে। আমার হাত পা ধরে কাঁদে। শুধু বলে তাকে একটু সময় দিতে। গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করেই ভালো একটা চাকরি পেয়ে আমার আদর কে বিয়ে করবে। ওর পরিবারের ব্যাপারে জানতে চাইলাম,বলল বাবা নেই। মা একাই অনেক কষ্ট করে ছেলেকে পড়াশোনা শেষ করাচ্ছে। বাড়ি গাড়ি তো দূরের কথা সাধারণ কোন জমি ও তাদের কেনা নেই। কোথায় জিহাদ আর কোথায় এই ছেলে! না! মেয়ের আবেগের কাছে বাস্তবতা এভাবে হারবে সেটা আমি বাবা হয়ে মেনে নিতে পারব না। তাই নিজে নিজেই প্ল্যান করা শুরু করলাম কিভাবে এই ছেলেকে আমার মেয়ের জীবন থেকে বের করা যায়। দিন দিন আমার ভদ্র মেয়েও উগ্র হয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই সে জিহাদকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না। অন্যদিকে জিহাদের পরিবার বারবার বিয়ের জন্য তাগিদ দিচ্ছে। একজন বাপ হারা গরিব পরিবারের ছেলের জন্য জিহাদের মত একটা ছেলে হাতছাড়া হয়ে যাবে এটা কোনোভাবে হতে দেওয়া যাবে না। তাই যা আমি কোনদিন ভাবি নি করব, তাই করলাম।
প্রথমে আদর কে গেস্টরুমে আনলাম এবং ওর রুম লক করে দিলাম। তো ওর কাছে যদি কিছু থাকেও ও এখন আর কিছুই ব্যবহার করতে পারবে না। ওই ছেলে কিংবা ওর কোন বন্ধুদের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারবে না। এখন থেকে আদর গেস্টরুমে থাকবে। আর একদিন পর বুঝতে পারলাম আমার প্ল্যান সাক্সেস হয়েছে। তারপরের দিন বিকালে আমি হাত থেকে ইচ্ছা করে পানি গ্লাস ফেলে দিলাম আর মাটিতে পড়ে চিৎকার করা শুরু করলাম যেন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছি। আদর আমার মোবাইল থেকে আমার ডক্টর বন্ধুকে কল দিল। আমার ডক্টর বন্ধুর সাথে আমার আগেই সবকিছু প্ল্যান করা ছিল। তো প্ল্যান মোতাবেক আমার ডক্টর বন্ধু বলল আমি বেশি দিন বাঁচবো না আর এখন আমাকে যেন কোনভাবে কোন কাজে উত্তেজিত না করা হয়। আর রুমের বাইরে কি বুঝালো বা বলল তা যদিও আমি জানিনা তবে মেয়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে আমি এতটুকু বুঝতে পারলাম যে আমার এই প্ল্যান ও সাকসেস হয়েছে। তারপর আমার বন্ধু চলে যাওয়ার পর আমার মেয়ে রুমে আসলো। আমি মেয়েকে কাছে ডাকলাম। আলতো করে আবেগ মাখা কন্ঠে বললাম, "দেখ মা, তোকে সেই ছোটবেলা থেকে বড় করেছি। আমি তো আর তোর খারাপ চাই না বল? পুরনো জিনিস সব ভুলে যা। জিহাদ অনেক ভালো একটা ছেলে। তোকে অনেক ভালো লাগবে। আমার কখন কি হয়ে যায় তার তো ঠিক নেই। পরশুদিনই জিহাদের সাথে তোর বিয়ের শুভ কাজটা আমি শেষ করে ফেলব। তুই মা আর না করে তোর বুড়ো বাপটা কে আর কষ্ট দিস না।" আদরের চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ল, ও কিছু বলল না। আমিও আর কিছু জানতে চাইলাম না।
কালকের মধ্যে সব আয়োজন করে রাখতে হবে যাতে পরশু কোন ছুট ঝামেলা ছাড়াই বিয়েটা হয়ে যায়। কোনরকম ঝামেলা ছাড়া বিয়েটা হয়ে গেল। আদরও শ্বশুর বাড়ি চলে গেল। নিজেকে খুব বিজয়ী মনে হচ্ছিল। তার ঠিক দুইদিন পর ওই ছেলেটি আবার আমার বাসায় আসলো। বলল আদরের কোন খোঁজ খবর পাচ্ছে না, আদর ঠিক আছে কিনা? তখন ওকে এই সুসংবাদ দিলাম যে আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে দুদিন আগে। ছেলেটির চেহারায় সাথে সাথে অন্ধকার নেমে আসে, চোখ ভিজে আসে। আমি স্পষ্ট সব দেখতে পারি। কিন্তু সেটা আমার দেখার বিষয় না, কারণ আমার মেয়ে এখন সারা জীবন সুখে থাকবে। শান্তিতে থাকবে। পায়ের উপর পা তুলে থাকবে। যদিও এত বছর বয়স হওয়ার পরও আমি ভুলে যাই যে জীবন আমাদের হিসাব অনুযায়ী চলে না। ছেলেটি আদরের শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা ঠিকই বের করে। আদরের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আদর আমার সম্মানের কথা ভেবে ওই ছেলেটার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। খুব গর্ববোধ হয় আমার মেয়ের প্রতি তখন। যাক! ভালো মেয়ে আমি বড় করেছি।
Nijeke 67 boyosh e dekhina ekhono, although icha ache 100 bochor beche thakar, kintu tobuo. Etodin beche ki korbo tai bhabchi.