জীবন থিওরি

in BDCommunity3 years ago (edited)

জীবন থিওরি

environmental-protection-326923_960_720.webp
Image score

প্রতিদিন ঘরে একটা না একটা অসুবিধা আছেই। যা যেমন আছে তাতে কেউ সন্তুষ্ট না। হয়তো কেউ কারো উপর নয়তো কোনো জড়ো বস্তুর উপর। এই ব্যাপারগুলো খুব বিরক্তিকর সত্যি । তারপরেও এইসব দেখতে দেখতে আর মেনে নিয়ে চালিয়ে যেতে হয় জীবনটা। দুনিয়াতে এত এত থিওরি, জীবন নামের একটা থিওরিও থাকা উচিত আসলে। এইযে রোজ রোজ ঘুম থেকে ওঠা, সকালের নাস্তা বানানো, সবাইকে খাওয়ানো, সবার কাজ গুছিয়ে দেয়া, নিজের কাজকর্ম, অফিসে যাওয়া, ফেরার পথে কার কি লাগবে সেটা নিয়ে আসা, না আনতে পারলে মুখকালো দেখা, সারাদিন খেটে দিনশেষে কারও একটা কিছু মনমতো না হলে সেটা নিয়ে কথা কাটাকাটি, মান অভিমান, নিজে যেমন আছি তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে দুনিয়ার বাকিরা কেমন আছে এইসব নিয়ে ঘাটাঘাটি, মন কষাকষি, জিনিসপত্রের মাপামাপির চেয়ে কে কি বললো সেটা নিয়ে দাড়িপাল্লা আর হিসেব নিকেষ... এতসব ব্যাপারগুলোর মধ্যে যে এখনো আমরা বেচেঁ আছি, নিঃশ্বাস নিচ্ছি এটাই তো অনেক বড় একটা পাওয়া আমি মনে করি।

ছোটো ছোটো এই ব্যাপারগুলো একটু কাছ থেকে দেখলেই বোঝা যায় আমরা কেউই জীবন যুদ্ধে জয়ী না। নামমাত্র যুদ্ধ করছি পাশের মানুষটার জন্য, নিজের পরিবারের জন্য, তাদের খুশির জন্য। এই একটা নিত্য দিনের চাকা...যার মধ্যে ঘুরতে গিয়ে আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলছি রোজ। হাসতে ভুলে যাই, কাদতে ভুলে যাই, নিজেদের আনন্দের জন্য কিছু করার কথা ভুলে যাই, দিনশেষে আমাদের নিজেদের জন্য যে একটু ভালোবাসা আর যত্ন তুলে রাখা দরকার সেটাও ভুলে যাই। নামেমাত্র মানুষ আমরা...একেকজন তো এইখানে তার পাশে কি হচ্ছে সেটা নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত, নিজের জন্য কিংবা নিজের আনন্দের জন্য কিছু করা দরকার আমরা বেশিরভাগ মানুষ সেটা ভুলে যাই একদম। মাঝে মাঝে মনে পড়লেও পাত্তা দেই না!

গতকাল ঘরে মাছ ডাল রান্না করেছিলাম কিন্তু আজকে ভর্তা ভাজি দিয়ে কাজ চালাতে হবে দেখে সবার মুখকালো,তাদের নাকি আজ খিদেই নেই! এই হচ্ছে মানুষের অবস্থা। সবসময় সমান চলে না,যখন যা যেমন থাকে তাতে তৃপ্তি খুঁজতে হয় এই কথাটা একদম ভুলে গিয়ে সবসময় সমান হারে চায় মানুষ। আর এইজন্যেই একটা সময়ে গিয়ে অশান্তি, বিরক্তি, মন কষাকষি, রাগ অভিমান আরো কত কত তিক্ত অনুভূতি জন্ম নেয়। এইযে বেলায় বেলায় ভালো খাবার খেতে চাওয়ার আবদার... একটু নিচের দিকে তাকালেই হয়। কয়টা মানুষ রোজ রোজ মাছ মাংস গিলতে পারে? একবেলার ডাল আর কয়টা ভাত জুটাতে গিয়ে কেউ হয়তো পথে পথে ঘুরছে, কেউ হয়তো মানুষের বাড়ি কাজ করছে, কেউ আবার ধার দেনা করে বেড়াচ্ছে। এটাই জীবন। ওইসব মানুষগুলোর জন্য এক বাটি ডাল আর এক মুঠো ভাত আমাদের মাছ মাংসের চাইতেও হাজার হাজার গুণ বেশি দামী। আর যারা অসুস্থ, নানা রোগে দম ফেলতেও যাদের কষ্টের শেষ নেই তারা? তারা তো পড়ে থাকে বিছানায়, খাওয়ার মত সুযোগ থাকলে খেতে পারে নাহয় ক্ষুদা পেটে বিছানার সাথে মিশে থাকে। তখন কাড়ি কাড়ি টাকা তাদের সুখ দিতে পারে না,খাবার তো দূর একটুখানি পানি যাতে খেতে পারে সেই আশায় কত আকুতি মিনতি। আহ্,জীবন....কারও কাছে সুখের মোড়কে আর কারো কাছে কুড়েঘরে বৃষ্টির মতন।

আমরা ঠিক যেমনটা ভাবি জীবন ঠিক তেমনটাই। হাজারটা চিন্তা মাথায় নিয়ে কেউ যদি দিনশেষে মন খুলে হাসতে পারে তার কাছে জীবন সুন্দর। আর কেউ যদি বিরাট বাড়ির ছাদে বসে কিভাবে আরো ....আরো অনেক টাকা আসবে সেই চিন্তায় ঘুম নষ্ট করে তাহলে তার কাছে জীবন একটা দুশ্চিন্তার পাহাড়ের মত। যার যা আছে তাতে খুশি থাকাটাও অনেক বড় একটা গুন। নিজের যা আছে টা আগলে রেখে বাঁচার মধ্যে, আনন্দে থাকার মধ্যে যে একটা তৃপ্তি সেটা আর কোথাও নেই। টাকা দিয়েও কিনতে পাওয়া যাবে না সেটা।জীবন নামক থিওরির প্রতিটা পাতায় পাতায় নানা রকম অনুভুতি,গল্প ,রহস্য লুকানো। কেউ যদি কষ্টের সব পাতাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে তাহলে আনন্দের পাতাগুলো তার দৃষ্টির বাইরেই থাকবে আর এর বিপরীতটাও একই ভাবে সত্য। মানুষের পুরোটা নিয়েই জীবন।এই পুরোটার মধ্যে একটা মানুষ বাকি মানুষগুলোর কাছে একেকরকম। কারও কাছে কঠিন, গম্ভীর। কারও কাছে খুব উপকারী একটা মানুষ, কারও কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আরো নানাভাবে এটাকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। কিন্তু প্রতিটা মানুষ যদি এটা ভাবত যে তার ভেতরটা কেউ দেখতে পারলে তখন তাকে কেমনটা ভাববে তাহলে জীবনটা হয়তো আরো সুন্দর হতো। কারণ একটা মানুষ কোনো না কোনো ভাবে আরেকটা মানুষের সাথে জড়িত। কিন্তু আফসোস এমনটা কেউ ভাবে না।

অবশ্য ভাবার মতো সময় তাদের হয় না। তারা ভাবে পাশের বাড়ির কে কি করলো, কে কি খেলো, কে কোথাও গেলো, কে কার কি ক্ষতি করলো, কে কোন খারাপ কাজ টা করলো আরো অনেক অনেক কিছু। সারাদিন রোবটের মত খেটে খাওয়া, মানুষের ভুল দোষ খুঁজতে থাকা এইসবের ভিড়ে নিজের ভেতরকার ভালোটা, আনন্দটা শূন্যের কোটায় গিয়ে ঠেকে। তখন আস্তে আস্তে মানুষ সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, বিরক্তি ভীর জমায় তার সবকিছুতে, সে যা করে একটা একটা করে সব তার কাছে ফেরত আসে তখন।

আমরা মানুষরা সত্যিই বড্ড অদ্ভুত। নিজের হাতে সব বিগড়ে দিয়ে অন্যের উপর দোষ চাপাই, নিজের আনন্দ নিজের হাতে পিষে তার দায়ভার অন্যের ঘরে বর্তে দেই, ছোটখাটো বিষয় পাহাড় সমান বানিয়ে নিয়ে রাগ অভিমানের দেয়াল গড়ে দেই চারপাশে। এতে আসলে নিজের ক্ষতি কিংবা বোকামি ছাড়া আর কিছুই হয় না। এইযে আমরা রাগ দেখাই, গুটিয়ে নেই নিজেদের.... এতে আসলে কারও বিন্দুমাত্র কিছু হয় না।যা হওয়ার আমাদেরই হয়। দিনশেষে আমরা একা বোধ করি, কান্না পায়, দম বন্ধ লাগে, ভেতরটা খুব বেশি ভারী মনে হয় আরো কত কত চাপা অনুভূতি যার শেষ নেই । ইজন্য কার কি আছে, আমার কেনো নেই, কে কি করলো তাতে মন খারাপ করাটা বেমানান। তার চেয়ে নিজের কি আছে, নিজে কি কি ভালো কাজ করতে পেরেছি, রোজ কয়টা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি এইসব ভেবে দিনশেষে বড্ড সুখ পাওয়া যায়, একটা সুখী মানুষের মতো ঘুমানো যায়, ভেতরে একটা বেশ বড়সরো তৃপ্তি কাজ করে তখন।

ছোটবেলায় একটা দুটো চকোলেট কিংবা আইসক্রিম পেলেই কেমন আকাশ সমান খুশি হয়ে যেতাম আমরা আর এখন পুরো দুনিয়াটাও যদি কেউ এনে দেয় আমরা খুশি হওয়ার বদলে দোষ খুঁজতে বসে পড়ি। মানুষ এমনই, তৃপ্তি কিংবা কৃতজ্ঞতা খুব কম তার মধ্যে। আর এই বিষয়টা অস্বাভাবিক হলেও আজকালকার দুনিয়ায় এটাতে সবাই খুব মানিয়ে নিয়েছে বলা চলে! প্রত্যেকটা বাবা মা কে যদি দেখি....তারা কোনোদিন কম করেনি আমাদের জন্য। কয়টা মানুষ এমন আছে যারা আমাদের ভালোর জন্য দুয়া করবে, যত্ন করবে, একটু অসুস্থ আছি শুনলেই অস্থির হয়ে উঠবে, মন খারাপ শুনলে শান্তনা দেবে, মাছের বড়ো টুকরাটা আমাদের জন্য উঠিয়ে রাখবে, নিজের পছন্দ হওয়া সত্বেও আমাদের কথা ভেবে সেটা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিবে, আমাদের খরচ জোগাতে নিজেরা একজোড়া ভালো জুতো কিনে পড়বে না এরকম মানুষ কয়টা হয়? হাতে গুনেও দুই তিনটার বেশি হবে না হয়তো। কিন্তু এইযে বাবা মা....রোজ রোজ...আমাদের জন্য এতসব করে। বিনিময়ে কোনো শর্ত জুড়ে দেয় না, কোনো কিছু চেয়ে বসে না, আমাদের ভাগ থেকে চাইতে আসে না।দুনিয়াতে যদি মানুষ হিসেবে কাউকে সুন্দর বলতে হয় তাহলে বাবা মা সবচেয়ে সুন্দর মানুষ আর তাদের জীবনটা? তাদের জীবনটা অন্য সব মানুষের চাইতে অনেক কঠিন, অনেক কষ্টের, অনেক অপেক্ষা, ঘাম, না খেয়ে থাকার।

তার মানে কি?ভালো একটা মানুষের জীবন সবসময় একটু কষ্টের হয়। এটাতে আফসোস করাটা নেহাত বোকামি। তার চেয়ে নিজের ভালো মানুষিকতা সবসময় পুষে রেখে দিনশেষে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নেয়াটাই সবচেয়ে আনন্দের। জীবন থিওরি আসলে শেষ হওয়ার মতো কিছু না,এটা খুব বিশাল কিছু। বইয়ের পাতায়, কলমের কালিতে কিংবা অন্য যত মাধ্যমেই হোক এটাকে কোনোদিন লিখে কিংবা বলে শেষ করা সম্ভব বলে মনে হয় না....