সাম্প্রতিক ফুটবলের পাঁচফোড়ন : আমাদের দেশের দর্শকসমাজ ও আমার দেখা একটি সমর্থন বিড়ম্বনা

in BDCommunity4 years ago (edited)

হ্যালো, বাংলাদেশ কমিউনিটি 🙂, সবাই কেমন আছেন? ভালো আছেন নিশ্চয়ই।
যারা, এদেশীয় হাইভার, তারা সবাই সকাল সকাল ভোরে ঘুৃম থেকে উঠে খেলা দেখছেন হয়তো। আজ, একটি আজব প্রেক্ষাপট, এদেশীয় ফুটবল অতীত অবস্থা নিয়ে কথা বলবো।

আমাদের দেশে ফুটবল নিয়ে উন্মাদনার বয়স কত বছর ধরে, তার সঠিক হিসাব টানা বেশ মুশকিল। কারন, ঠিক কত বছর আগে এদেশে ফুটবল নামে একটা খেলা লোকেমুখে, পাড়া মহল্লায়, জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করেছিল তার সঠিক সময়রেখা টানা আমার পক্ষে একটু দুরূহ ব্যাপার।তার জন্য প্রামান্য- বইপত্র, ইতিহাসের রেফারেন্স টানতে হবে। কেতাবী আলোচনায় না যাই। বরং কিছু প্র্যাক্টিকাল দিক তুলে ধরি।

কখন থেকে ফুটবল আসরের মজায় পড়লাম আমরা, কবে থেকে চায়ের দোকানগুলোতে পিরিচে ঢেলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিশ্বকাপের কথা বলেছি, পাড়ার মাঠে শক্ত ডিয়ার ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি করেছি,বড় দেখে পতাকা টাঙানো, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া ও ঝালমুড়ি, বিরিয়ানি, তার হিসাব মেলানে কঠিন হবে না।
তবে ছোট থেকেই বড় পর্দায় রাত জেগে ,পপকর্ন মুড়ি মুড়কি সন্দেশ খেয়ে,পছন্দের দলের জার্সি গায়ে দিয়ে, পায়ে ফুটবল নিয়ে পায়চারী করে ঐ সেই উন্মাদনায়, ফুটবল ফেভারে ভুগেছি তা আজো চোখের সামনে দেখতে পাই।

_75362359_dsc_2121.jpg
Image
তবে, ইদানীং যেহেতু ফুটবলের মরসুম চলিতেছে, উপমহাদেশের আপামর মানুষের প্রিয় দুই দলের জমজমাট লড়াইয়ে ভরপুর কোপা আমেরিকার ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, লকডাউনের মধ্যে থেকেও একটা উৎসব উৎসব আমেজ বয়ে চলেছে, তার নিরিখে কিছু কথা বলবো বলে ভাবছি কিছুদিন ধরে।

গত কিছুক্ষন আগে, ব্রাজিল বনাম পেরুর সেমি ফাইনাল খেলা শেষ হয়েছে, বেশ রোমাঞ্চকর ও জমজমাট, টান টান উত্তেজনা ছিল ম্যাচটাতে, তা নিঃসন্দেহাতীত ভাবে বলা যায়।

নিজেদের মাটিতে, বেশকিছু তরুন প্রতিভাবান খেলোয়াড়, হালের জনপ্রিয় প্লেয়ার, উদীয়মান তারকা, বিশ্বসেরা ফুটবলার আছে দলটিতে। টিম হিসেবে দুর্দান্তও বটে।পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই ব্রাজিল ভালো খেলেছে, তা বোঝাই যাচ্ছে তাদের দলীয় পারফর্ম্যান্স দেখে।

সেমিফাইনালে পেরুকে হারাতে তেমন বেগ পেতে হয়নি দলটিকে, যদিও দল হিসেবে পেরু কঠিন প্রতিপক্ষ ছিল না।
ডিফেন্স জমিয়ে রেখে, মিডফিল্ড সাজিয়ে, দারুন আক্রমন তৈরি করতে পেরেছিল ব্রাজিল। তার ফলস্বরূপ প্রথমার্ধেই একটি গোল পেয়ে যায় এবং ম্যাচ জিতে ফেরে।

images.jpeg
Image
অন্যদিকে, পুরো টুর্নামেন্টেই আর্জেন্টিনা ভালো পারফর্মেন্স দেখিয়েছে, তা বলাই যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে আর্জেন্টিনা সমর্থন করি, কিন্তু তারপরো গঠনমূলক সমালোচনার ব্যাপারে এক চুলও ছাড় দেই না।

মূল আলোচনায় যাবার পূর্বে, আর্জেন্টিনার এ কোপা আমেরিকা আসরের পারফর্মেন্স সম্পর্কে বলে যাই।
দেখুন, যে দলটি বেশকিছু বছর ধরে অনেকাংশেই মেসিনির্ভর হয়ে খেলতো, বিশ্বজোড়া ক্লাবভিত্তিক লিগগুলোতে সেরা প্লেয়ার হতো, মেসিকে রাইট উইংয়ে রেখে, স্ট্রাইকে হিগুয়েইন, এগুয়েরো, ডি মারিয়া ইত্যাদি খেলোয়াড়রা কখনো একার কৃতিত্বে গোল করতে পারতো না, দল জিতলে মেসির পারফরম্যান্সেই জিততো, হারলে মেসির কারনেই হেরেছে, এমন প্রতিক্রিয়া আসতো বিশ্বমহল ফুটবলবোদ্ধাদের থেকে,
এবারের কোপার আসরে কোচ স্ক্যালোনির নেতৃত্বে, পুরো দলীয় পারফরম্যান্সই দেখা যাচ্ছে,যেটা যেকোনো কাপ খরায় ভোগা দলের জন্যই স্বস্তিকর।

কারো একার কৃতিত্বে কোনো ম্যাচ জেতা যায়, কিন্তু কোনো টুর্নামেন্ট জেতা যায়না।

যা হোক, পুরো কোপার গ্রুপপর্ব ও কোয়ার্টারে মেসি প্রত্যেকটা ম্যাচেই ভালো খেলেছে, গোল করেছে এবং করিয়েছে যা ইতিবাচক দিক ছিল।
সেমিফাইনালে এসে কলম্বিয়ার বিপক্ষে তেমন জুতসই খেলা উপহার দিতে পারেনি৷ আবার, কলম্বিয়ার মারদাঙ্গা ফাউল করার মানসিকতাও ভুগিয়েছে দলটাকে।
২০১৪ সালে কলম্বিয়া যখন ব্রাজিলের বিপক্ষে খেলেছিল, তখন, জানিনা আপনাদের মনে আছে কিনা, জুনিগার হাঁটুতে নেইমারের সিঁড়দাঁড়ায় চিড় ধরেছিল,
স্ট্রেচারে করে হসপিটালে ভর্তি করাতে হয়েছিল, এই সেই কুলাঙ্গার কলম্বিয়া এবারো মেসির বাঁ পায়ের গোড়ালি বরাবর বুটের স্পাইক দিয়ে বেশ কয়েকবার পরিকল্পিতভাবে জোরালো আঘাত করেছিল, যাতে রক্ত গড়িয়ে পড়েছিল মেসির৷
তারপরে এসে, গোলকিপার মার্টিনেজের কৃতিত্বে এবারের মতো টাইব্রেকে রক্ষা পেয়ে ফাইনালে আর্জেন্টিনা।

যা হোক, ফাইনালে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াই দেখার অপেক্ষায় আছে পুরো বিশ্ব।

images (1).jpeg
Image
এবার আসি মূল আলোচনায়, যার জন্য আজকের ব্লগ লিখতে বসা। আজকের বিকেলে সংবাদপত্র পড়তে বসে কিছুক্ষন জাতীয় খবরাখবর পড়ছিলাম। মলাট পাতায় করোনার আপডেট, উপাত্ত, রাজনীতির ইতিবৃত্ত, লকডাউন, আইন শাসন, জরিমানা, কড়াকড়ির ছড়াছড়ি, শোবিজ, স্বাস্থ্যপাতা ইত্যাদি উলটিয়ে যখন খেলার পাতায় গেলাম তখন একটি নিউজ দেখে চোখ আটকিয়ে গেল আমার।

নিউজটি এমন,

{ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে, ব্রাজিল আর্জেন্টিনা সমর্থকরা বিদ্রুপ টিটকারির এক পর্যায়ে কথা কাটাকাটি থেকে এক ব্রাজিল সমর্থক অন্য আর্জেন্টিনা সমর্থকের মাথা ফাটিয়ে ফেলল। ভিকটিম এখন সদর হাসপাতালে ভর্তি }...

এ নিউজটা দেখে কিছুক্ষন হাসবো না কাঁদবো, এটা নিয়ে ভেবেছিলাম। এসব ছাগলের ৩ নং বাচ্চা সমর্থকরা কোথা হতে জন্ম নেয়, আমার দেখার অনেক দিনের শখ৷

তাদের কীর্তিকলাপ দেখে আমার রবীন্দ্রনাথের একটা কথা মনে পড়ে যায়,
" ৪ কোটি ছেলের ঐ গর্বিত জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করোনি। "

লেখাটার শুরুতে বলেছিলাম, আমাদের দেশে কবে থেকে ফুটবল নিয়ে এতো মাতামাতি তার জন্মলগ্ন নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। স্বাধীনতার আগে থেকেই পাকিস্তান পিরিয়ডে মোহামেডান আবাহনী স্পোর্টিং ক্লাবগুলো আন্ঞলিক পর্যায়ে ক্রীড়ামোদী মানুষদের বিনোদন দিতো। ৬০ এর দশকে ক্রিকেট বলে কোনো খেলা আছে, ৭০ ভাগ মানুষ বিষয়টা জানতো না।
মানুষ ভীরমি খেয়ে স্টেডিয়ামে এই স্পোর্টিং ক্লাবগুলোর খেলা দেখে মুগ্ধ হতো।
তারপর ধীরে ধীরে, স্বাধীনতার পর অন্য দলগুলোর আবির্ভাব হলো, শেখ জামাল, শেখ কামাল ক্রীড়াচক্র, সাইফ স্পোর্টিং ইত্যাদি।

২০০০ সালের পর ক্রিকেট জনপ্রিয়তা লাভ করে কারন, নিজের দেশ বিশ্বমঞ্চে খেলছে, অন্য দলকে হারাচ্ছে।
কিন্তু, ফুটবলের যে চিরাচরিত আমেজ, মানুষদেরকে টানার ক্ষমতা, তা অতুলনীয়ই থেকে যায় অধুনা দিন পর্যন্ত।

দেখুন, ইউরোপীয় ফুটবল, গতিময় ফুটবল এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। বিগত বছর গুলোতে বিশ্বকাপে লং পাস, ক্রস খেলা,স্পিড আর রোবটিক ফুটবলশৈলিতে শিরোপা জিতে নিচ্ছে ঠিকই কিন্তু চিরাচরিত ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবলের যে তাল, লয়, ক্ল্যাসিকাল উপস্থাপন, টিকি টাকা, শৈল্পিক জাদুকরি সৌন্দর্য, মোহনীয় খেলা, তার সাথে কোন অংশে ফুটবল মাধুর্যে ইউরোপীয় ফুটবল কুলোবে না, তা স্পষ্টতই দেখা যায়।
পমহাদেশের মানুষ ইউরোপীয় কাপ না দেখে কোপা আমেরিকা দেখছে এবং উপভোগ করছে তার মূল কারন ঐ যে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের শৈল্পিক খেলা।

images (2).jpeg
Image

download.jpeg
Image
পেলে, ম্যারাডোনারা যে কিংবদন্তী ফুটবল দেখিয়েছে, রূপকথার গল্পের মতো ইতিহাস রচনা করেছে, তাতেই মানুষ মুগ্ধ হয়েছে।

এবার একটি কথা বলে শেষ করতে চাই, দেখুন খবরের কাগজে যে নিউজটা দেখলাম, তার পেছনে যে ঘটনাটা আছে, তা বড়ই পীড়াদায়ক।
সামান্য তুচ্ছ ফুটবল খেলায় সাপোর্ট করা নিয়ে যে অফেন্সিভ আচরন করা, বৈরিভাবে অন্যকে আঘাত করা, ট্রলকে পুঁজি করে গালিগালাজ করা, ভেংচি কাটা, হাতাহাতি মারামারি করে এরা কোন রুচির পরিচয় দেয়?

এদের মানসিকতা কেমন?
কতটুকু নিচু পর্যায়ের আচার ব্যবহার এদের?
ভাবতেই অবাক লাগে, যেকোন ফুটবলের বড় আসরে এরকম কোনো না কোন ঘটনা এরা ঘটায়। শতমাইল দূরের ব্রাজিল আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করে, মেসি নেইমারের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তর্কে জড়িয়ে মারামারি করে, এদের নিজেদের কি লাভ?
কতটুকু বোকা হলে এরা নিজের দেশের নিজের রক্তের সাথে মারামারি করে বেড়ায়?

আমার মাথায় ধরে না। এদের মানসিকতা কি পর্যায়ের তা আমার জানা নেই, তবে এদের অবস্থা দেখে দয়ার উদ্রেক হয়, খারাপ লাগে।

একটা কথা বলি কি, ফুটবলকে ভালোবাসলে, ফুটবল নিয়ে আবেগ কাজ করতেই পারে। ডাই হার্ড ফ্যান হতেই পারা যায়, নিজের জায়গা জমি, ভিটেমাটি বিক্রি করে আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলের ইয়া লম্বা পতাকা বানানোও যায়, কিন্তু, যদি আদর্শ ফ্যান হিসেবে পরিচয় দিতেই হয়, তাহলে [পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ] ও [পরমতসহিষ্ণুতার] মধ্যে আসতে হবে।

আমি আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করি, তাই বলে কি ব্রাজিলকে ছোট করার চেষ্টায় নামবো, নিম্ন রূচির ট্রল বের করবো?

আমি ব্রাজিল সাপোর্ট করি বলে কি, আর্জেন্টিনার গোষ্ঠী উদ্ধার করবো?
অযথা তর্কে জড়িয়ে মারামারি করবো?

এসবের কিছুই হতো না, যদি উপরে ব্র্যাকেট করা দুটি গুন নিজের চরিত্রের মধ্যে গড়ে তুলতাম। কিছুই হতো না, যদি অন্য দলের সমর্থকদের কথারও গুরুত্ব দিতাম, বন্ধু হিসেবে মনে করতাম।

খেলা নিয়ে ঝগড়া বিবাদ, ট্রল করাই যেতে পারে কিন্তু শ্রদ্ধাবোধ রেখে, অন্যের মতকে সহ্য করার চেষ্টা করতে পারলে, আজ এই লজ্জাস্কর খবরের কাগজের শিরোনাম হতে হতো না।

যা হোক,
ব্রাজিল আর্জেন্টিনা ফাইনাল দেখতে মুখিয়ে আছি।
আমি মেসির আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করছি, আপনি কোন দল সাপোর্ট করছেন?????