বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সেন্টলুসিয়া থেকে ডোমিনিকা যাওয়ার সমুদ্র ভ্রমণ এর তিক্ত অভিজ্ঞতা সকল মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছে।কেউ কেউ বলছে এর দায়ভার কার? এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার জন্য অনেক উপায় থাকে। দেখবেন কেউ সখ করে সমুদ্র ভ্রমণ করে ২/৩ গুন টাকা বেশি খরচ করে। আবার কেউ সময় বাঁচাতে বিমানে চলে যায়। ক্রিকেট দলের জন্য পূর্ব থেকে নির্ধারিত এই পথ,চাইলেই কি পরিবর্তন করা যেতো? হয়তো যেতো কিন্তু জাহাজ ভাড়া গচ্ছা যেতো। তাতে আমাদের ক্রিকেটাররা হারাতো সমুদ্র অভিযানের এই বিশাল অভিজ্ঞতা। জীবনে আর কোন দিন হয়তোবা এই সুযোগ আসবেও না। যাই হোক আমি সেই কথা বলতে বসিনি।
Pic Source
১৯৮৬ ইং সালে নৌবাহিনীর চাকুরীতে জয়েন করে প্রথমে ছয় মাস বানৌজা তিতুমীর খুলনা তে,পরে নয় মাসের ট্রেনিং বানৌজা শহিদ মোয়াজ্জেম কাপ্তাই এ শেষ করে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যে জাহাজটিতে প্রথম জয়েন করি তার নাম ছিলো "বানৌজা আবু বকর"। প্রচন্ড উন্মাদনা,সাগরের উচ্ছলতা উত্তালতা উপভোগ করার ব্যকুলতা নিয়ে জাহাজে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি।কবে যাবে জাহাজ সীট্রিপে? ২০/২৫ দিন পর পর সিডিউল আসে।জাহাজের সবার জুনিয়র সেইলর আমাদের বেসের সবাই। কোন কাজ মানেই আমরা যারা নতুন তাদের ডাক সবার আগে। নিজ ব্রাঞ্চ এর সকল যন্ত্রপাতি চালানো শিখা,এরপর এক্সট্রা কাজ করা। তখন নৌবাহিনীর তিনটি ফ্রিগেট ছিলো।তারই একটি ছিলো বানৌজা আবু বকর। এই আবু বকর জাহাজ টি ১৯৫৫ ইং সালে প্রথম স্কটল্যান্ড এ তৈরী হয় HMS LYNX নামে। ১৪মার্চ ১৯৫৭ ইং সালে রয়াল নেভীর সপ্তম ফ্রিগেট স্কোয়াড্রনে যুক্ত হয় এবং ১২মার্চ ১৯৮২ ইং পর্যন্ত জাহাজটি ব্যবহৃত হয়। এটি লম্বায় ৩৩১ ফিট ও প্রস্তে ছিলো ৩৫ ফিট। ১৮ নটিক্যাল মাইল স্পিডে চলতে পারতো। বাংলাদেশ নৌবাহিনী এই জাহাজটিকে প্রায় ৩২ বছর সচল রাখে এবং ২২ জানুয়ারি ২০১৪ ইং সালে ডিকমিশন করে দেয় এবং একই নামে আরেকটি নতুন ফ্রিগেট সংযুক্ত করে।
Pic Source (ছবিটি বিএনএস আলি হায়দার এর)
(আবু বকর জাহাজ টি দেখতে কেমন ছিলো তার কোন ছবি না থাকায় আপনাদের বুঝাতেই সিস্টার শীপ বানৌজা আলী হায়দার এর ছবি দিলাম।)
প্রথম যেদিন সাগরে টহল দিতে যাই আমাদের নতুন নাবিক সবার কি যে মহা আনন্দ মনে প্রানে বলে বুঝানোর কোন ভাষা আসলেই জানা নেই। জীবনে প্রথম সাগরের বুক চিরে চলার আনন্দ। কর্ণফুলী নদীতে নেভাল জেটি।এই নদী যে কত প্রবল খরস্রোত নিজ চোখে না দেখলে উপলব্ধি করার উপায় নাই। তিনটি ফ্রিগেট এক নাম্বার জেটিতে বাধা থাকতো। একটির যখন সাগরে যেতো হতো দেখা যেতো বাকি দুইটির বা একটিকে ও সরে যেতে হতো,সাত বা দশ দিন পর পর নাড়াচাড়া করতে হতোই।সব চাইতে বিরক্তিকর ব্যপারটা যা ছিলো,সেটা হচ্ছে মোটা মোটা হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ এর তার খুলে জাহাজে তোলা আবার এসে লাগানো।
৩৩১ ফিটের এতো বড় জাহাজ কোন দিন দেখাও হয়নি,ভ্রমণতো পরের কথা।নিজের খুব গর্ভবোধ হতো এতো বড় জাহাজের নাবিক আমি। মজার ব্যাপার হচ্ছে বহরের বাকি সব জাহাজ যেনো এদের বাচ্চা। কোন কারনে পাশে ভিড়লে মনে হতো ওরা মায়ের কোলে পরম সুখে মহা আনন্দে আছে।ডকইয়ার্ড বা নেভাল স্টোরে গেলে দেখতাম ফ্রিগেট এর অগ্রাধিকার।
কর্ণফুলীর এই স্রোতের মাঝেই সাম্পান নিয়ে মানুষ পানি থেকে পোড়া তেল তুলে নেয়,মাছ ধরে,প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করে আবার সুযোগ পেলে চুরি ও করে।পতেংগা মোহনা দিয়ে বের হলেই দেখা মিলে আউটার এ্যাংকরেজ এ নোংগর করা বিশাল বিশাল বানিজ্যিক জাহাজ। যেগুলো পোর্ট এ আসতে পারেনা। লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে লোড আনলোড করতে হয়।এক একটা জাহাজের ভিতর ৮/১০ টা ফ্রিগেট জেনো অনায়াসে ডুকিয়ে দেওয়া যাবে।আমাদের পতেংগা মোহনার পানি কাদাময় হওয়ায় খুব একটা ভালো লাগে না আমার কাছে। যেদিন প্রথম সাগর ভ্রমণ এ যাই নেভী চার নাম্বার ড্রেস পরা তার উপর লাইফ জ্যাকেট পরেই থাকতে হবে যদি ডিউটি আপার ডেকে হয়।আমাদের রেডিও ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এর ইকুইপমেন্ট গুলো আপার ডেকেই থাকে আর ওয়ারকশপ থাকে ভিতরে।তাই ডিউটি আপার ডেকে হবার সুবাদে সাগরের রুপ উপভোগ করা অনেক সহজ হয়ে যায়।সবচাইতে কস্টকর ব্যাপার ছিলো জুন জুলাই মাসে।আমাদের প্রিয় বংগপোসাগর সাধারণ ভাবেই খুব জেদি। এরপর মোহনা থেকে বের হয়ে যখন দঃক্ষিন পশ্চিম দিকে ২৭০ ডিগ্রীতে নাগরদোলা খেতে খেতে চলতে থাকে যাকে রোলিং পিচিং বলে,তখন আমাদের ক্রিকেটারদের যেমনটা হয়েছে তেমনই অবস্থা চলতে থাকে। আমাদের সমুদ্রসীমায় ফ্রিগেটকে ৭/১০ দিন ঘুরে ঘুরে টহল দিতে হয়।ভারত মায়ানমার এর মাছ ধরার ট্রলারকে পাহারা দেয়াটাই মূল কাজ।
যখন সাগরে যাই তখন মনে হয় এবারই শেষ,গিয়েই অব্যবহিত চাইবো।কিন্তু হারবারে আসার পর আর সেই কস্ট মনে থাকেনা।সমুদ্রের রোলিং পিচিং এর জন্য কিছুই খাওয়া যায় না। বমি করতে করতে অনেকের রক্ত ও বের হয়।কার উপর কে বোমি করছে,বমি করতে করতে কে কোথায় পড়ে থাকে কোন হুস থাকে না। কেউ টয়লেটে,কেউ বাথরুমে, কেউ লবিতে বমির উপরই পড়ে থাকে। প্রথম দিকে জাহাজের পানি রিফাইন করার মেশিন ছিলো।পরে সেটা যখন পারমানেন্ট ভাবে নস্ট হয়ে যায় তখন আর পানি সারাক্ষণ থাকতো না,যে পানি সারাক্ষণ থাক্তো তা ছিলো সল্ট ওয়াটার,সেটা শুধুই বাথরুমে ব্যবহার করা যায়,অন্য কোন কাজে লাগে না। পানির মাঝে থেকেও পানির অভাব।মজার ব্যপার এতো কিছুর মাঝেও আবার কেউ কেউ ওভার লোড খেয়েই যায়,কোন অসুবিধা হয় না।তিন চার জনের খাবার একাই খায়। যারা ডুবুরি বা কমান্ডো ট্রেনিং করে থাকে তাদের কিছুই হয় না। আর সে জন্যই তাদের আলাদা একটা কদর থাকে কমান্ডের কাছে।
একবার এই আবুবকর জাহাজে চাকুরী কালে ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম। উপরের ডেকে থাকার কোন উপায় নেই। সকল পোর্টহোল বন্ধ করে দেয়া হয় সমুদ্রে যাওয়ার আগেই। আবহাওয়া ভালো থাকলে,সমুদ্র শান্ত থাকলে ইচ্ছে করলে খোলা যায়। সব দরজা গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।কাউকে আপার ডেকে চলা ফেরা করতে বারন করা হয়েছে। আমার ডিউটি ছিলো ব্রিজে।ব্রিজের রাডার সহ বিভিন্ন নেভিগেশন যন্ত্রপাতি চালানোর এবং তা রক্ষনাবেক্ষন এর ডিউটি আমাদের ব্রাঞ্চের।
Pic Source
(এটি একটি রাডার ডিসপ্লে,যার সাহায্যে একটি জাহাজের দিক নিরদেশনা ও অন্য জাহাজের গতিপথ দেখা, লোকেশন সহ সকল হিসাব পাওয়া যায়।)
এক একটা ঢেউ এর সাথে সাথে জাহাজের মাথা সাগরে ঢুকে যায় আবার বের হয়ে আকাশের দিকে তাকায়। মনে হয় এই বুঝি ডুবেই গেলাম।চারিদিকে শুধুই পানি। জাহাজের সব কিছুই বেধে রাখা হয়। শক্তি দিয়ে দুই হাতে কিছু না ধরে দাঁড়ানোর কোন উপায় থাকে না। বোঝানোর কোন উপায় নেই সেই ক্ষনের অবস্থা। এই ভিডিও টা দেখলে বুঝতে পারবেন জাহাজ প্রবল ঝড়ের অবস্থা কি হয়-
অন্ধকার এ সমুদ্রের যে রুপ তা হয়তো কবিতা লিখার জন্য ভালো হতে পারে। ভালো হতে পরে চাঁদ আর নক্ষত্রের খেলা দেখার জন্য। দূরে চারিদিকে আকাশ আর সমুদ্রের মিলন দেখার জন্য। কখনো মাঝে মাঝে কোথাও দেখা মিলে অন্য কোন বানিজ্যিক জাহাজ বা মাছ ধরার ট্রলার এর।দেখা মিলে জাহাজের সাথে সাথে ডলফিন মাছের দৌড়ে চলা।
একদিন বা দুইদিন পর একটু বডি ও মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য সেন্টমারটিনে জাহাজ নোঙর করে। সবাই দ্বীপের ফ্রেশ পানিতে গোসল করে,মন প্রান ভরে নারিকেল জিঞ্জিরার ডাবের পানি পান করে আর বেশি করে কিছু কিনে নিয়ে আসে।
[Pic Source]
এখানকার অধিবাসীদের প্রধান পেশা মাছ ধরা আর শুটকি বানানো।কেউ কেউ সাগরতলের প্রবাল তুলে এনে পরিস্কার করে বিক্রি করে।যা দিয়ে ঘর সাজানো যায়।
Pic Source
যেহেতু মাছ এই দ্বীপের প্রধান আইটেম তাই এখানে উৎপাদন হয় শুটকি মাছ। যাদের পরিবার চট্টগ্রামে থাকে তারা তা কিনে নিয়ে আসে।
বানৌজা আবু বকর জাহাজে চাকুরী করেছি দুই বছর। শেষ দিকে শুভেচ্ছা সফরে যাই সার্ক ভুক্ত তিনটি দেশে। সেই গল্প না হয় আরেকদিন বলবো।
ভালো থাকবেন।শুভ কামনা সবার জন্য।
আখতার উজ জামান
তারিখঃ
০৫ই জুলাই, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ
৫ই জিলহজ, ১৪৪৩ হিজরি
২১ শে আষাঢ়,১৪২৩ বঙ্গাব্দ
মঙ্গলবার
সময়ঃ ০৯-৩০ সকাল
Life as a Marine is truly struggling. And just seeing the video I feel like I will throw up, so, can imagine how it feels to be inside the ship. :v
Thanks for your service to the country, sir.
Congratulations @auzaman! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s):
Your next target is to reach 30 posts.
You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP
To support your work, I also upvoted your post!
Check out the last post from @hivebuzz:
Support the HiveBuzz project. Vote for our proposal!