যদিও অন্য অনেক কিছুর মত বাংলা কবিতায় আধুনিকতা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই এসেছে... তবে প্রকৃত আধুনিক কবিতা বাংলা সাহিত্য পেয়েছে যার হাত ধরে.. তিনি জীবনানন্দ দাশ।
আধুনিকতা আসলে একটা প্রপঞ্চ, একটা প্রকল্পের নাম.. কিংবা এক আন্দোলনের নাম.. এই আন্দোলনকে সত্যিকারভাবে বাংলা ভাষায় ব্যবহার করতে তিরিশের কবিদের বিশেষ প্রচেষ্টা স্মরণীয়.. বিশেষ করে ৫ জন বিখ্যাত মহান কবি.. যাদেরকে একসঙ্গে পঞ্চপান্ডব বলা হয়.. তারা খুব সুন্দর ভাবে রবীন্দ্রধারাকে পাশ কাটিয়ে আধুনিক কবিতা চর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন.. তাদের প্রধান ছিলেন জীবনানন্দ দাশ...
জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা কোনটি?.. এই প্রশ্ন যখন আমরা শুনি... প্রথমে আমাদের মাথায় আসে বনলতা সেন'র কথা.. অবশ্যই বনলতা সেন একটি অসাধারণ কাব্য.. তবে আমাকে বনলতা সেন-এর চেয়েও বেশি আকর্ষণ করে আট বছর আগে একদিন কবিতাটি।
কবিতাটি যতবার পড়ি, ততবার মুগ্ধ হই... বর্তমান সময়ে কবিতাটি এত বেশি প্রাসঙ্গিক যে- আমাদের জীবন যাপনের সাথে পুরোপুরি খাপ খেয়ে যায়.. আসলে চিরায়ত সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য এটাই.. তা সময়োত্তীর্ণ হয়.. সকল সময়ের পাঠককে তা সমানভাবে আকর্ষণ করে.. ঠিক আট বছর আগে একদিন কবিতাটিও সেরকম ভাবে আমাদের আজও আকর্ষণ করে যায়.. বিনোদন দিয়ে যায়..
আমরা যখন শহরের জীবনে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত এবং বিভ্রান্ত হয়ে রাতের বেলা ঘুমহীন চোখে জেগে থাকি.. তখন শুধু শূন্যতা দেখতে পাই.. তখন মনে হয় কবিতাটি যেন আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি।
এই কবিতায় মূলত একজন ব্যক্তি আত্মহত্যার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে.. তার স্ত্রী তার পাশে শুয়েছিল.. সন্তানও ছিল.. তবু হঠাৎ করে কেন যেন তার ঘুম ভেঙে গেল... এবং সুইসাইড করে ফেলল। এই যে অন্তরের শূন্যতা এবং আত্মহত্যার সুপ্ত বাসনা.. এটা যেন নাগরিক জীবনের একটা নিরব স্কেচ।
কবিতাটি শুরু করেছেন কবি একেবারে হঠাৎ করে.. পাঠক প্রথম লাইনটি পড়া মাত্রই একটা ধাক্কা খায়.. চলে যায় সোজা কোন একটা মেডিকেলের অন্ধকার আলো আবছায়ার লাশকাটা ঘরে-
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাদ
মরিবার হল তার সাধ।
সে কেন মারা গেল.. কিভাবে মারা গেল.. পাঠক যখন এই সকল প্রশ্নে ঘুরপাক খায়.. তখন কবি অকপটে ব্যাখ্যা করেন:
বধু শুয়ে ছিল পাশে-শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল জোছনায় তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল-
লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
কোন ভূতে তার ঘুম ভেঙে দিয়েছিল.. কেন সে বেছে নিল মৃত্যুর পথ.. এই দোলাচলে পাঠক দুলতে দুলতে পরবর্তী লাইনগুলোর দিকে যখন এগিয়ে যায়.. তখন অসাধারণ কিছু পংক্তি খুঁজে পায়:
এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার
কোনোদিন জাগিবে না আর।
‘কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর-’
এই কথা বলেছিল তারে
চাঁদ ডুবে চলে গেলে অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।
জীবনানন্দ দাশের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো উপমার বৈচিত্র.. তিনিই প্রথম বাংলা সাহিত্যে এতো বিচিত্র এবং ভিন্ন আঙ্গিকের উপমা ব্যবহার করেছেন যে- পাঠকই স্তব্ধ হয়ে উপমা নিয়ে ভাবতে শুরু করে.. যেমন বনলতা সেনের চুলকে অন্ধকার বিদিশার নিশা অথবা চোখেকে পাখির নীড়-এর সঙ্গে তুলনা করে তিনি পাঠকদেরকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন.. ঠিক তেমনি নিস্তব্ধতাকে উটের গ্রীবার মতো যখন উল্লেখ করেছেন.. তখন পাঠক থমকে দাঁড়ায়.. একটু ভাবে.. কল্পনার সাগরে হাবুডুবু খায়.. এবং হারিয়ে যায়।
রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি।
মানুষের জীবনকে এত সুন্দর কাব্যিক ভাষায় জীবনানন্দ ছাড়া আর কেউ অনুবাদ করতে পারেন না। এই যে আত্মহত্যা.. একটা জগত থেকে অন্য আরেকটা জগতে চলে যাওয়া.. সেটাকে কবি তুলনা করেছেন- রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে উড়ে যাওয়া মাছি-র সাথে। কি অসাধারণ গভীর জীবনবোধ।
তারপরে লাইনগুলোতে কবি নাগরিক জীবনের শূন্যতা স্থবিরতা এবং ক্লান্তিকে অনুবাদ করেছেন অক্ষরে অক্ষরে..
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।
জানি-তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, র্কীতি নয়, সচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত ক্লান্ত করে:
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।
কবিতাটি যখন শেষ করি.. প্রতিবার নিজেকে আবিস্কার করি লাশকাটা ঘরে। মনে হয় যেন- আমিই শুয়ে আছি অন্ধকারে.. টেবিলের 'পরে.. লাশকাটা ঘরে.. হাজার হাজার বছর ধরে..
উল্লেখ্য যে..
বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে প্রিয় কবিতা ছিল এটি.. এমনকি এই কবিতার আলোকে তিনি একটি ছোট উপন্যাসও লিখেছেন.. উপন্যাসের নাম: যখন গিয়াছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ.. ধারণা করা হয়- বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস এটি।