লালন ফকিরের গান আধুনিক সময়ে নতুন করে আমাদের সমাজে এসে ধরা দিয়েছে.. অনেকেই এখন লালন সংগীত শুনেন.. সেই বাউল সহজিয়া সুরের লালন সংগীত নয়.. বরং ব্যান্ড ভোকালের কন্ঠে ড্রাম এবং হেভি মেটাল মিউজিকের ফিউশনে নতুনধারার যে লালন সংগীত চর্চা শুরু হয়েছে.. বর্তমান সমাজে তা খুব বেশি জনপ্রিয়।
আমি এই ধারার পক্ষে বিপক্ষে কথা বলবো না। তবে যারা লালন সংগীত শুনছে এখন.. পছন্দ করছে.. তাদের একটি বড় অংশ সংগীতের অর্থ এবং তার তাৎপর্য অনুধাবন করে না.. কেবল শব্দের আকর্ষণ এবং সুরের মূর্ছনায় মোহিত হয়।
ফলে বর্তমান সময়ের লালন শ্রোতাদের বেশিরভাগের কাছে লালন সংগীত মানে একটা ঘোর লাগা অনুভূতির নাম.. তারা সেই ঘোরের মধ্যেই থাকে.. এর গভীরে যে মাহাত্ম্য, সেই অন্তরীক্ষে তারা প্রবেশ করতে পারে না.. প্রবেশ করতে চাইও না।
মূলত আমার আজকের আলোচ্য বিষয় ছিল- একটি বিখ্যাত সঙ্গীত.. তিন পাগলের মেলা.. গানটি শুনে নি, এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অনেকেই পছন্দ করে.. কিন্তু গানটির মাহাত্ম্য কয়জন বুঝতে পারে... আমার সন্দেহ আছে..
তিন পাগলের হলো মেলা নদে এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে..
এই যে তিনজন পাগলের কথা বলা হয়েছে.. এরা কারা, সেটা অনেকেই জানে না.. অথচ গানের মধ্যেই তাদের পরিচয় দেওয়া আছে.. এবং লালন ফকির ইচ্ছে করে পরিচয়টা শেষের দিকে দিয়েছেন।
নদে বলতে এখানে নদীয়াকে বোঝানো হয়েছে। মেলা বলতে মিলন অথবা আখড়া... দুটোই বোঝানো যায়।
তিন পাগল নদীয়াতে গিয়ে মিলেছে.. অথবা নদীয়াতে তাদের আখড়া স্থাপন করেছে.. তারপরে লালন ফকির সবাইকে সাবধান করেছেন.. কেউ যেন সেই পাগলদের কাছে না যায়.. এই সাবধানবাণী আসলে সতর্কবাণী নয়.. এটা এক ধরনের বক্রোক্তি।
আমরা অনেক সময় এ ধরনের বক্রোক্তি আমাদের ভাষায় ব্যবহার করি.. যেমন আমরা বলি- কুমিল্লার রসমালাই খেলে পাগল হয়ে যাবে.. তার মানে এই নয় যে- সত্যি সত্যি কেউ কুমিল্লার রসমালাই খেলে পাগল হয়ে যাবে.. ঠিক তেমনি লালন ফকির পাগলের কাছে যেতে না করেছেন.. তার মানে তিনি বুঝাচ্ছেন- পাগলের কাছে গেলে মানুষ এতটাই মোহিত হয়ে যাবে যে.. ফিরে আসা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে।
যে তিনজন পাগলের কথা তিনি বলেছেন.. তাদের একটি করে বৈশিষ্ট্য তিনি উল্লেখ করেছেন.. যেমন: প্রথম পাগল পাগলামি করে এমন..
একটা পাগলামি করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে
দ্বিতীয়জন হরি হরি করতে করতে ধূলার মধ্যে লুটিয়ে পড়ে..
আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে
ধূলার মাঝে..
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে..
আর তৃতীয় জনকে তিনি বলেছেন- নারকেলের মালা। নারকেলের মালার আরেক নাম করঙ্গ.. অর্থাৎ এইটা এক ধরনের পরিমাপক যন্ত্র.. এটা দিয়ে জল বা অন্য কোন তরল পরিমাপ করা যায়.. তৃতীয় পাগল সেই জল তোলা ফেলা করেন সারাদিন..
একটা নারকেলের মালা
তাতে জল তোলা ফেলা..
করঙ্গ সে..
তিন পাগলের তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে তিনি সবাইকে সাবধান করছেন- যেন কেউ তাদের কাছে না যায়.. গেলে তারা তাদের কার্যক্রম থেকে তাদের মত হয়ে যাবে..
পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি
বুঝবি শেষে..
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে..
সবাইকে কৌতুহলের মধ্যে রেখে.. তারপর লালন ফকির শেষের দিকে পাগলদের নাম উল্লেখ করেন..
পাগলের নামটি এমন
বলিতে অধীন লালন হয় তরাসে
চৈতে নিতে অদ্বৈ পাগল
নাম ধরে সে..
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে..
মূলত চৈতে হলো শ্রী চৈতন্যদেব, নিতে এবং অদ্বৈ হলো তার দুই বিখ্যাত শিষ্য সহচর.. নিত্যানন্দ এবং অদ্বৈত আচার্য।
এই গানে লালন ফকির মূলত বাউল সাধনের শক্তি এবং তীব্রতা অসম্ভব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই একটি সংগীত উপলব্ধি করাই যথেষ্ট.. লালন সংগীতের প্রকৃত গভীরতা এবং জীবনবোধ সম্পর্কে ধারণা পেতে।
Hi @bdkabbo, your post has been upvoted by @bdcommunity courtesy of @rehan12!
Support us by voting as a Hive Witness and/or by delegating HIVE POWER.
JOIN US ON
বেশ! এ গানের পেছনের মর্মার্থ জানা ছিলো না।
আচ্ছা, বক্রোক্তির শাব্দিক পূর্ণরূপ কি 'বাঁকা উক্তি'?
বক্রোক্তি কথাটি সাহিত্যে পজিটিভ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর মানে কোন একটি কথা ঘুরিয়ে বলা।
সেটা তো বুঝলাম, শাব্দিক অর্থের বুৎপত্তি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলাম আরকি।