যখন আমি স্কুলে পড়তাম তখন তার সাথে আমার প্রথম দেখা। স্কুলে আমার বন্ধু বলতে শুধু একজনই ছিল আমার বান্ধবী। একদিন ক্লাস শেষ করে বান্ধবীর সাথে কথা বলতে বলতে ক্লাস থেকে বের হচ্ছিলাম আর এমন সময় তার সাথে আমার ডান হাতে হালকা একটু ধাক্কা লাগে। তখন সে ক্লাসের দিকে যাচ্ছিলো। ধাক্কা লাগার পর আমি ওরদিকে ঘুরে তাকালাম আর সেও আমার দিকে ঘুরে তাকালো। আমি এতক্ষনে ওকে অনেক গুলো কথা শুনিয়ে দিলাম রাগ দেখিয়ে। কিন্তু সে যেন আমার দিকে তাকিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলো। আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে ছিল মনে হচ্ছিলো আমি ওর সাথে অনেক ভালোভালো কথা বলছি। আমার কথা গুলো কোন পাত্তাই দিলো না। আমার বান্ধবী আমাকে টেনে নিয়ে চলে গেলো।
ওর নাম ছিল আবির। সেদিনের পর থেকে প্রতিদিন সে আমার ক্লাসের সামনে দাড়িয়ে থাকত। আর এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। সে কখনো আমাকে কোনোকিছু বলার মত সাহস পেতো না। তবে এটা আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে সে আমাকে ভালোবাসে। এভাবেই কাটছিলো দিন গুলো। একদিন হটাৎ করে বাবার পোস্টিং হওয়ার কারণে আমরা এই শহর ছেড়ে চলে যাই অন্য কোনো এক শহরে। সেখানে গিয়ে সবকিছু মিলিয়ে একটু খারাপ লাগলেও কিছুদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যায়। নতুন স্কুল ভর্তি হলাম নতুন বান্ধবী হলো সবকিছু নতুন করে শুরু করলাম।
কিন্তু সেখানে আবির আমাকে পাগলের মত খুজেছে। যে খুজতে খুজতে আমার বাসা পর্যন্ত নাকি গিয়েছে কিন্তু আমার দেখা সে পাই নি। সে রয়ে গেলো অপেক্ষায় কখন সে আমার দেখা যাবে। চলে গেল দশ বছর। স্কুল , কলেজ পেরিয়ে আমি এখন একটা কোম্পানিতে চাকরি করছি। আমার জীবনে সব কিছুই স্বাভাবিক ছিল। এত দিনে অনেক বড় হয়ে গেছি আমি। আমার অফিসের চাকরির সুবাধে আমার ভিবিন্ন সময় ভিবিন্ন জায়গায় যেতে হয়। এমনি একদিন আমার সিলেটের দিকে যাওয়ার কথা হলো। হা তবে আমি একা না অফিসের আরো একজন মেয়ে কলিক আমার সাথে থাকবে।
আগের দিন ট্রেনের টিকেট কেটে রাখলাম। পরের দিন সকালে নিজেকে তৈরী করতে করতে একটু দেরি হয়ে যাচ্ছিলো স্টেশনের কাছে গিয়ে দেখি সেই ট্রেন প্লাটপর্মে দাঁড়িয়ে আছে কিছুক্ষনের মধ্যে ছেড়ে যাবে। তখনি আমি দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠার সময় ধাক্কা লাগে আমার সেই আবিরের সাথে। আজকের ধাক্কাটা আমি দিয়েছিলাম তাড়াহুড়া করে উঠতে গিয়ে। কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারিনি। কারণ সে এই কয়েক বছরে অনেকটাই বদলে গেছে। আমি ট্রেনে উঠার পর তারদিকে ঘুরে তাকিয়ে সরি বলে ভিতরে চলে গেলাম। কিন্তু সে আমাকে চিনে ফেলেছিলো যে আমি সেই অনন্যা যাকে সে হারিয়ে ফেলেছিলো।
আমি সরি বলার সময় খেয়াল করেছিলাম সে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আমি ভিতরে গিয়ে আমার কেবিনের সিটে বসে পড়ি। সে আমাকে তখন খুজতে থাকে ট্রেনের ভিতরে প্রতিটা সিট। কারণ সে আর আমাকে হারাতে চাই না। ভাগ্যক্রমে তার সিট ছিল আমার কেবিনের ভিতর। ট্রেনের পুরো বগি খুজে না পেয়ে সে এসেছিলো তার নিজের সিটে বসতে তখনি সে দেখে আমি তার সিটের পাশেই বসে আছি। সে আমাকে দেখে তখন কি করবে কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। আমি আমার বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলাম।
আবিরের সাথে ছিল আবিরের এক বন্ধু। সে আগে থেকেই ট্রেনে সিটে বসে ছিল। সে সেদিন আমার সাথে কোন কথা বলেনি। শুধু ভাবছিলো সে কি করবে আর কি বলবে। ট্রেনের পথ শেষ হয়ে গিয়েছে এবার আমাদের নামতে হবে। আমি ও আমার বান্ধবী ট্রেন থেকে নেমে গেলাম। আবিরের আরো বেশ দূরে যাওয়ার কথা কিন্তু সেও আমাদের পিছন পিছন নেমে গিয়েছিলো। কিন্তু আমরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেলেও আবির বের হতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে । কারণ তার কাছে টিকেট ছিলো না। টিকেট তার বন্ধুর কাছে ছিল। স্টেশনের গেইটে তাকে আটকে রাখে বেশ কিছুক্ষন। পরে সে আর আমাকে খুজে পাইনি।
আমি ট্রেনের ভিতরে থাকা অবস্থায় ফোনে মাকে বলেছিলাম আমি অফিসের কাজ শেষ করে দুই দিন পর ফিরবো সেই কথা শুনে সে দাঁড়িয়ে ছিল আমার অপেক্ষায় স্টেশনের গেইটে। কিন্তু আমি আমার অফিসের কাজ শেষ করে বাসে করে চলেগিয়েছিলাম। কিন্তু এদিকে আমার জন্য আবিরের অপেক্ষার মুহুর্থ আর শেষ হলো না। সে এখানে আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে কাটিয়ে দিলো পাঁচ বছর। ততদিনে আবিরের মুখে বয়সের চাপ বসে গিয়েছে। সে এখন স্টেশনের পাশে একটি বইয়ের দোকান দিয়েছে। আর সেই দোকান থেকে তাকিয়ে থাকে স্টেশনের দিকে কখন আমি আবার ফিরে আসবো।
এমনি একদিন একটা হলুদ শাড়ি পরে আমার অফিসের এক জন বড় ভাইয়ের সাথে সেই ট্রেনে করে এই স্টেশন ছেড়ে আরো দূরের কোথাও যাওয়ার পথে এই স্টেশনে এসে ট্রেনে একটি সমস্যা দিয়েছে। এখান থেকে ট্রেন ছাড়তে বেশ সময় লাগবে। তাই ভাবলাম নিচে থেকে একটু ঘুরে আসি। আমি ট্রেন থেকে নেমে সেই স্টেশনের বইয়ের দোকানে গেলাম আর বই গুলো দেখতে থাকলাম। আবির আমাকে দেখে সে যেন এক নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। এই স্টেশনের প্রত্যেকটা মানুষ জানে এই আবিরের হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার কথা। আমাকে দেখে আজ সে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। কোনো কিছুই সে বলতে পারেনি। গায়ের মধ্যে একটা চাদর পেচিয়ে রেখেছে। চুল গুলো অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার নিজের প্রতি কোনো মায়া বা যত্ন নেই।
আমার তাকে আবছা আবছা চিনা চিনা লাগছে। তাই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনাকে আমার কেমন যেন চিনা চিনা লাগছে। সে বললো হা আপনি একটু দাড়ান আমি এখনই আসছি। তারপর আপনাকে বলছি। এই কথা বলে সে গিয়েছিলো ফুল আনতে সে এবার আমাকে এই স্টেশনকে সাক্ষী রেখে আমাকে সবার সামনে প্রপোজ করবে বলে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তখন আমার সেই অফিসের বড় ভাই এসে আমাকে তুমি করে করে বলতে লাগলো কি করছো এখানে ? চলো ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। আর তখনি আবির তাকে দেখে ভাবে সে আমার স্বামী। আর হাতের পিছনে থাকা লাল গোলাপ গুলো ফেলে দিয়ে চলে যাই এখান থেকে।
তাকিয়ে দেখলাম স্টেশনের চারদিকে মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে। আর একজন চিৎকার করে করে বলতে আবিরের অনন্যা ফিরে এসেছে। তখনি আমি বুঝে গিয়েছিলাম এই আবির আমার আমার সেই আবির যে আমার জন্য পুরো জীবনটাই অপেক্ষা করে পার করে দিয়েছে।
আমি তখন আবিরকে খুজতে থাকি কিন্তু আমি তাকে পাইনি। ভুল ভেবে অভিমান করে সে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমিও সেদিন আর যায়নি। আবার আমার তার জন্য অপেক্ষার করার পালা। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেলো তার কোনো দেখা আমি পাইনি। অনেকের কাছে আমি জিজ্ঞাসা করেছি তার বেপারে কিন্তু কেউ তার ঠিকনা বলতে পারে না। এভাবেই আমিও আমার নিজের জীবনের অনেকটা সময় পার করে দিয়েছি কিন্তু তার দেখা পেলাম না।
এই গল্পের শেষ তা আমি করিনি। কারণ কিছু কিছু গল্পের শেষ হয় না।
Congratulations @farzanaakter!
You raised your level and are now a Minnow!
Check out the last post from @hivebuzz: