ছেলেটির আসল নাম যে কি তা এই পাড়ার লোকজন ভুলিয়াই গিয়েছে। তাকে কেন জানি সবাই ওস্তা বলিয়া ডাকে। ওস্তা পড়ালেখায় যেনতেন প্রকারের হলেও দুঃসাধ্য কাজগুলিতে তার প্রচন্ড উৎসাহ। তো ওস্তার মাধ্যমিক পরিক্ষা সবেমাত্র শেষ হলো। সামনে এখন তার অফুরান অবকাশ। ওস্তা ঠিক করলো এই দীর্ঘ ছুটি সে মামার বাড়ি ভোগ করবে। তাই সে তার নিত্য ব্যবহার্য বস্তুগুলি নিয়ে নানার বাড়ি চলে গেল।
ওস্তার নানার বাড়ি পাক্কা একটা গেরস্ত বাড়ি। গোয়াল ভরা গোরু ও গোলা ভরা ফসল তার নানা বাড়ির অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। ওস্তার বড় মামা সাবেক মিলিটারি সৈনিক। অবসরে আসিলেও কোন প্রকারের একটা বন্দুক বিশেষ কায়দায় সংগ্রহ করে বসার ঘরটার সিংহাসন সদৃশ আসনটির সোজা উপরে দেয়ালের সাথে লটকিয়ে সেঁটে রেখেছে।
বলিয়া রাখা ভালো যে, ওস্তার মামা এক কঠোর তপশ্চর্যাপূর্ণ ব্যক্তি। সব কিছুকে যথা স্থানে ও সঠিক ভাবে দেখতে সে অভ্যস্ত। সে এই আত্ম নিরোধী শৃঙ্খলাগুলো রপ্ত করেছে মিলিটারি জীবন থেকে। বাড়ির কাউকে কোন কাজে সামান্য হেরফের ও বোকামি দেখলে ওস্তার এই মিলিটারি মামা, কাউকে ওই দেয়ালের সাথে লটকানো বন্দুকটি আনার হুকুম করিয়া হুঙ্কার ছাড়িতেন।
ওস্তা তার এই মামাকে যমের মতো ভয় করতেন। তাই ওস্তা তার কোন কাজে যেন সামান্যও ত্রুটি পরিলক্ষিত না হয়, সে ব্যাপারে অতি তৎপর।
ওস্তা ভালো-মন্দ খেয়ে গায়ে ফুঁ দিয়ে দিন গুজরান করতে লাগেন। কোন প্রকারের কেলেঙ্কারি এখনও তার দ্বারা সংঘটিত হয়নি।
আষাঢ় মাস। চারি দিকে থৈথৈ জল। বাদলের আগমন হরহামেশাই হচ্ছে। সূয্যিমামার অবস্থান এখন পশ্চিম আকাশে। এমন সময় ওস্তার সেই মিলিটারি মামার শ্বশুর বাড়ি থেকে এক ঝাঁক মেহমানের আগমন ঘটলো। মেহমানদের পরিবেশনের জন্য ভালো কিছু বাড়িতে অবশিষ্ট নেই। বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব কয়েক ক্রোশ। তাছাড়াও এই অবেলায় বাজারে কিছু পাওয়া দুষ্কর। ওস্তার মামী মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেহমানদের জন্য কি রান্না করবেন ভেবে পাচ্ছে না। তো
ওস্তা তার মামীর এই উদ্বিগ্ন অবস্থা দেখে অভয় দিয়ে তার মামীকে বলল,"ওস্তা থাকতে মেহমানরা ডাল-ভাত খাবে তা হতে পারে না, এটি ওস্তার জন্য অপমানজনক। আপনি মাংস রাঁধার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করে ফেলুন।" এই বলে ওস্তা তার মামার বন্দুকটি নিয়ে সোজা বিলের দিকে চলে গেল।
ওস্তা বিল থেকে কয়েকটি পুঁটিমাছ ধরলো। তারপর তার মামার গোয়ালঘরের পাশ থেকে লম্বা ও সোজা একটি বাঁশ নিল। বাঁশের এক মাথা সে গোয়ালঘরের পাশের একটা বাউলা গাছের সাথে বেধে দিল। এবার জিগা (গ্রামাঞ্চলে জন্মানো এক ধরনের বনজ বৃক্ষের আঞ্চলিক ডাক নাম) গাছের আঠার সাহায্যে পুঁটি মাছগুলো ওস্তা বাঁশের উপর সাজিয়ে রাখলো। লোহার শিকের সাথে মাংস গেঁথে পোড়ালে যেমন দেখায় বাঁশটিকে এখন তেমন দেখাচ্ছে। পার্থক্য শুধু মাংসের স্থানে পুঁটিমাছ। তারপর ওস্তা বন্দুকটির নল বাঁশটির এক প্রান্তে স্থির করে নিয়ে পাথর হয়ে দাড়িয়ে রইলেন।
মিনিট দশের মধ্যেই সাদা বকের একটি ঝাঁক এসে বাঁশটির উপর বসলো পুঁটিমাছগুলো খাওয়ার জন্য। এবার ওস্তার পালা। ওস্তা বন্দুকের লিভারে একটা চাপ দিতেই দশটি বক কপোকাত।
ওস্তা মনে মনে নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করতে লাগলো। "কিভাবে এক গুলিতে দশটি বক শিকার করলাম, আহ!" বকগুলো নিয়ে ওস্তা সোজা চলে গেল তার মামীর রান্নাঘরে। ওস্তার এই কান্ড দেখে তার মামী অবাক। ওস্তা কিভাবেই না এবার তার মান রক্ষা করলো। মুহূর্তের মধ্যে ওস্তার এই দুঃসাহসিক বক শিকারের কান্ড পুরো বাড়ি রটে গেল। ওস্তার প্রশংসায় এখন সারা বাড়িতে ধন্য ধন্য শব্দ হতে লাগলো। ওস্তার মিলিটারি মামা বলল, "এই না সে আমার ভাগ্নে! ওস্তা বলে কথা।" এবার ওস্তার জয়জয়কার।
কিছুক্ষণ পর ওস্তা কি একটা কাজে তার মামার গোয়ালঘরে প্রবেশ করলো। গোয়ালঘরের দৃশ্য দেখে ওস্তার চোখ কপালে উঠে গেল। ওস্তা দেখতে পেল, তার মামার পালের সবচেয়ে বড় দুধেল লাল গাভীটার পেট থেকে চুয়ে চুয়ে রক্ত ঝরছে। ওস্তার কারণ বুঝতে বাকী রইল না। ওস্তার চোখে পড়লো গোয়ালঘরের পাশের বাউলা গাছটার সাথে যে, বাঁশটির একপাশ বাঁধা ছিল তার মাথার কয়েক গজ পরেই বাধা ছিল এই লাল গাভীটা। যখন সে বন্দুকের লিভারে চাপ দিয়েছে তখন বন্দুকের সেই গুলিটি সোজা বাঁশের উপর বসে থাকা দশটি বক একেএকে অতিক্রম করে এই গাভীটিকে পাকড়াও করে। ওস্তার দ্বারা যে এবার গোরু মেরে জুতাদানের চাক্ষুষ নজির স্থাপন হয়ে গেল। কিন্তু এই আহত গাভীটি এখনও কারো নজরে আসেনি।
ওস্তার হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। গোয়ালঘরের পুষ্ট মশাগুলি তার কানের কাছে ভনভন করতে শুরু করলো। ওস্তা ভাবলো, মামা এই গাভীর এহেন অবস্থা দেখতে পেলে যে বকের সাথে আমাকেও রান্না করে খাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ কথা ভেবেই তার সর্বাঙ্গ অবশ হতে লাগলো। কিন্তু নিজেকে বাঁচানোর জন্য তার মস্তিষ্ক এখনও কিছুটা সচল। তারপর সে তার মামীর ঘর থেকে ন্যাপ সেলাইয়ের সূচ এনে সুতলি দিয়ে গাভীর পেটের ক্ষত স্থানটি সেলাই করে দিল। কিন্তু তাতেও রক্ত ঝরা বন্ধ হলো না।
ওস্তা এখানে আর একমুহূর্ত বিলম্ব করা সমীচীন মনে করলো না। কিছুক্ষণ পরেই যে তার উপার্জন করা সমস্ত প্রশংসা গোলা হয়ে কামান গর্জে ফিরে আসবে। তাই ওস্তা এবার নিরাপদ স্থানে প্রস্থান করলো।
কিছুক্ষণ পর এশার নামাজের আজান শুরু হলো। মুয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠে ভেসে আসতে লাগলো, আল্লাহু আকবর! আল্লাহু আকবর!
আজানের শব্দ শুনে ওস্তার মামার মনে হলো রাত যে অনেক হয়েছে, গোরুগুলোর কাছে তো যাওয়া হলো না। তাই তিনি একটি টর্চ লাইট হাতে গোয়ালঘরে প্রবেশ করলেন। তার সখের গাভীটির এমন অবস্থা দেখে তার চক্ষু চরাক গাছ হয়ে গেল। রক্তে গোয়ালঘরের মেঝে সিক্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে তুলকালাম শুরু হয়ে গেল। ওস্তার মামা তার বন্দুকটি হাতে নিয়ে মিলিটারি কায়দায় হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে ওস্তাকে তলব করতে লাগলো, কিন্তু কেউই তার সন্ধান পেলনা। এই ঘটনার পরে যে ওস্তার মামার মানসিক অবস্থা কেমন হয়ে ছিল তা বলাই আতিশয্য।
তারপর অনেকদিন কেটে গেল। ওস্তার আর মামার বাড়ি যাওয়া হলো না।