বই রিভিউ 'ঠাকুমার ঝুলি' লেখক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

in BDCommunity3 years ago (edited)

IMG_20220224_105608.jpg

IMG_20220224_105350.jpg
শেষ কবে আপনি রূপকথার গল্প শুনেছেন? আমাদের তো আর সকলের ঠাকুমা, দাদী, নানি বেঁচে নেই যে, তাদের সাথে বসে রসিয়ে রসিয়ে গল্প শুনব। কত জনের তো আবার তাদেরকে দেখারও সৌভাগ্য হয়নি। সেই শৈশবে যখন আমরা ঘুমাতে চাইতাম না তখন আমাদের মায়েরা আমাদেরকে শুনাতো রাজকন্যা, রাজপুত্র আর শিয়াল পন্ডিতের গল্প।
রাতে যখন আমরা একখানা বই দেখতাম তখন আমাদের চোখ ঘুমে ঢুলু ঢুলু হয়ে যেত। বই হাতে কখন যে আমরা ঘুমের রাজ্যে চলে যেতাম টেরই পেতাম না।
পক্ষান্তরে যখন আমরা ওই বইয়ের গল্পটি আমাদের নানি-দাদি মায়ের মুখে শুনতাম তখন আমাদের চোখে ঘুমোই আসতো না।
আমরা বলতাম -মা, আরেকটি গল্প শুনাও না!

বাংলা সাহিত্যের যে কয়জন লেখকের বইয়ের গল্প আমাদের নিরক্ষর নানি-দাদি ও মায়েরা জানতো তাদের মধ্যে অন্যতম হলো, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। শৈশবে আমাদের ঠাকুমারা যে, তাদের গল্পের ঝুলি থেকে সব লোমহর্ষক গল্প বের করে একে একে আমাদেরকে শুনাতো, তার বেশিরভাগই ছিল এই রূপকথার রাজা দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের।
পূর্বে ফুপু, দাদা-দাদী, নানা-নানি ও আমাদের মায়েদের জীর্ণ-শীর্ণ ঘরের কেরোসিন প্রদীপের আড্ডায় আমরা শুনতাম, বেঙ্গমা-বেঙ্গমী, হুতুম আর ভূতুমের গল্প।

আজ আমাদের মাঝে ওই ছেঁড়া কাঁথা গায়ে জড়ানো রসিয়ে গল্প বলিয়ে মানুষ নানিজান, দাদিজান হয়তো বেঁচে নেই। আমাদের মাঝে আর বেঁচে নেই ওই সন্ধ্যা বেলার কেরোসিন প্রদীপের আড্ডা।
ওই আড্ডায় আমাদের নানি-দাদি বলতেন,

  • এক দেশে এক রাজা ছিল। রাজা একদিন, হাটতে হাটতে হাটতে...........তারপর যে কি? তা আমার আর মনে করতে পারছি না।
    শিয়াল পন্ডিতের গল্প আমরা ভুলেই গিয়েছি। কিংবা, মনে করতে পারছি না বেঙ্গমা আর বেঙ্গমীর মজার কেচ্ছ।
    ঘুমন্ত পুরীর ওই ঘুমন্ত রাজকন্যার ঘুম কি ভেঙ্গে ছিল?
    সাত ভাই চম্পা কি রাজার মালীকে অর্ঘ্য বিরচনের ফুল দিয়েছিল? মনে নেই আমাদের।
    আমি বলছি আপনাদের, তাহলে আপনি একঝলকে পড় ফেলতে পারেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের লেখা, 'ঠাকুমার ঝুলি' বইটি।
    বইটিতে দুধের সাগর বাদে মোট ১৮টি গল্প রয়েছে।
    আপনি হয়তো সহজ-সরল নির্বিবাদ একজন মানুষ। সমাজে সবসময় শোষিত হচ্ছেন। ঠকিয়ে যাচ্ছে আপনাকে চালাকের দল। বিপরীতে আপনি শুধুই ধৈর্যধারণ করে যাচ্ছেন। বইটির গল্পগুলো পড়লে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার জয় সুনিশ্চিত।
    এখানে এখানে হিংসুক রাণী আর শক্তিশালী দৈত্য কখনো জিততে পারেনা।
    'ঠাকুমার ঝুলি' বইটি সাজানো হয়েছে ধৈর্যশীল ও পরোপকারীদের জয়ের আবহে।
    এ বইটির গল্পগুলোর মধ্যে আমার কাছে সবচে বেশি ভালো লেগেছে 'কাঁকনমালা, কাঞ্চনমালা' গল্পটি।
    রাণী কাঁকনমালা যখন তার শরীরের জড়োয়া গহনা ও কাপড় খুলে নদীতে স্নান করতে নামে তখন কাঞ্চনমালা নামে একজন দাসী এসে রাণীকে জিজ্ঞেস করে, আপনার কি দাসী লাগবে?
    জবাবে রাণী বলে, আমার কাছে তো এখন কোন মহর নেই যে, আপনাকে তা দিয়ে কিনবো?
    দাসী তখন রাণীর কাঁকনের বিনিময়ে বিক্রি হয়।
    রাণী যখন নদীতে ডুপ দেয় তখন ওই দাসী রাণী কাঁকন ও কাপড় পড়ে ভূয়া রাণী সেজে চলে যায় অন্দর মহলে।
    তখন আসল রাণী দুঃখ করে বলে,
    -কাঁকন দিয়ে কিনলাম দাসী, দাসী হইল রাণী
    আর রাণী হইল দাসী।

আবার
"পাই একহাজার সূঁচ,
তবে খাই তরমুজ।
সূঁচ পেতাম এক হাজার
তবে যেতাম হাটবাজার। "
এরকম সুন্দর সুন্দর উক্তির জন্য গল্পটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে।
কলাবতী রাজকন্যা, ঘুমন্ত পুরী, কিরণমালী, শাঁখচুন্নি, শিয়াল পন্ডিত, সাতভাই চম্পা সহ প্রতিটি গল্প-ই অসাধারণ রঙ্গ-রস আর অভিযানে ভরা।
আমার বিশ্বাস আপনি যদি গল্পগুলোর প্রথম আট-নয় লাইন পড়েন তাহলে সম্পূর্ণ গল্প পড়তে বাধ্য হবেন।

শেষে আমি বইটির 'সাতভাই চম্পা' গল্পের পারুল ফুল এবং চম্পাফুলের কথোপকথন দিয়ে শেষ করছি....
পারুল ফুল- "সাতভাই চম্পা জাগরে!"
চম্পা ফুল- "কেন বোন, পারুল ডাকরে।"
পারুল ফুল-"রাজার মালী এসেছে,
পূজার ফুল দিবে কি না দিবে?"

সাত চম্পা-"না দিব, না দিব ফুল উঠিবে শতেক দূর
আগে আসুক রাজা তবে দিব ফুল।"