Fatima

in BDCommunity3 years ago

রাতের নিকষ কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে পৃথিবীটাকে। অন্ধকারে এখন নিজের হাত-পা দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। আজকের রাতে কেন জানি দূর থেকে কুকুরের বুক্কন শব্দটিও ভেসে আসছে না। নীরব,নিঃস্তব্ধ। কোন সারা শব্দ নেই। ক্লান্তির অবসন্নতা সকলকে গ্রাস করে নিয়েছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন গ্রামবাসী।

শুধু ব্যতিক্রম ফাতিমা। ফাতিমার চোখে ঘুম নেই। স্বামীর খিটখিটে আচরণ ও বড় পরিবারের থালাবাসন ফাতিমার কচি হাত-পা গুলোকে পোড়া কাঠ বানিয়ে দিয়েছে। ফাতিমা মর্মাহত। মানুষেমানুষের জীবনে কি শুধুই কষ্ট। নাকি কেবল আমার জীবনেই? জানিনা জীবনের কোন অপরাধে এমন স্বামীর ঘর মিললো। ফাতিমার এমন ভাবনা প্রায়শই হয়। ফাতিমার এমন প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই।
ফাতিমা এখন এসব ভাবছে আর দু চোখ বেয়ে ক্রমাগত অশ্রু ঝরছে। অশ্রুতে বালিশটি ভিজে একাকার। এরই ফাঁকে ফাঁকে আঁচল দিয়ে মুখ মুছে নিচ্ছে ফাতিমা।
এমন করে প্রায় সে কান্না করে। ফাতিমা বিয়ের সময় তার বাবার পা ধরে কেঁদে-পিটে বলেছিল,"বাবা, আমার বয়স হয়নি। আমি অনেক পড়াশোনা করবো। তাছাড়াও ছেলেটার বয়স বেশি, বোকা, বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। দেখছোই তো আমার চেয়ে দ্বিগুণ বয়স; দেখতে কেমন। যার সাথে সারা জীবন কাটাবো, তাকে যদি পছন্দই না হয় কিংবা এখন যদি আমি সংসারের ভারই বহন না করতে পারি, তবে সে বিয়ের মূল্য কি? ওর সাথে আমার বনবে না, বাবা। আমি এখন ছাদনা তলায় যাবো না বাবা। আমি এ বিয়ে মেনে নিতে পারবো না। তবু কেন এখন ওর সাথে আমাকে বিয়ে দিচ্ছো? প্লিজ বাবা, বিয়েটা ভেঙ্গে দাও।"
ফাতিমার এক সাথে দুটো আপত্তি। ফাতিমা তার বাবকে অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু বাবা মেয়ের কথায় কান দেয়নি। বিয়ের তারিখ পাকা। এখন আর বিয়ে ভাঙ্গা সম্ভব নয়। মানুষ ভুল বুঝবে। সমাজ ত্যাড়া চোখে দেখবে।

সবচে বড় কথা হলো ফাতিমার বাবা নিরুপায়। ছেলেটার দাগে কয়েক বিঘা ধানিজমি। প্রতিদিন সের সের দুধ বিক্রি করে বাজারে। এমন সম্বন্ধ তো আর প্রতিদিন আসে না। তাছাড়াও আজকালকার ছেলেদের যে অবস্থা! গ্রামে ওদিকে কিশোরদের আন্ধার গ্রুপ, টিকটক গ্রুপ। না বাবা আমি আর এই শ্বাপদ সংকুল সমাজে আমার মিয়েকে আর বিপদের মুখে ছেড়ে দেবনা। মেয়েটার বয়স অল্প। ও অত বিপদ আর ভবিষ্যৎ এখন বুঝবে না। তাই একটু কান্না-কান্নি করছে। স্বামীর ভালোবাসা পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এমন ভাবনা ভেবেই ফাতিমার বাবা এসব কিছুর আয়োজন করেছে।

ফাতিমারা এক ভাই দু'বোন। ফাতিমা সবার বড়। ৯ম শ্রেণিতে পড়ে। এমন অবস্থায় ফাতিমার বিয়ে হয়।
আজ বৃহস্পতিবার। ফাতিমার বিয়ের তিন বছর পূর্ণের দিন। ফাতিমা এখন এক সন্তানের জননী। আরেকটা পৃথিবীর আলো দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।
ফাতিমার দু'ঠোটের দু'প্রান্তের ছেদ বিন্দুতে সাদা প্রলেপ জমেছে। চোখের নিচে কালি। হাত-পা হলদে রং ধারন করেছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের ডাক্তার আপা বলেছে, ফাতিমা এ্যামিনিয়া বা রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। কচু শাক, ছোটমাছ ও মুরগির কলিজা খাওয়াতে হবে এবং গোবরের ঢেবরি ও টিউবওয়েল থেকে পানির কলসি এখন আর বহন করা যাবে না।
ফাতিমার শাশুড়ী তো এসব কথা শুনে বেজায় রাগ।
-না বাপু আমরা অতো জমিদার না যে, বাড়ির বৌয়ের জন্য দাসী-বান্দী রেখে দেব।
ফাতিমা তার শ্বাশুড়ির কথায় কর্ণপাত করে না। মুখে আঁচল দিয়ে সে ধুকরে ধুকরে কান্না করে।
ফাতিমা এখন জীবিত লাশ। এই কি ফাতিমার ভবিষ্যৎ! এটাই কি ফাতিমাদের বাবাদের আজন্ম লালিত মেয়ের নিরাপদ আবাস!

যে বয়সে ফাতিমার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে সবুজ লনে বসে আড্ডা দেওয়ার কথা, সে বয়সে এখন ফাতিমা হাঁড়ি-পাতিল ঠেলছে। যে মেয়েটি ভবিষ্যতে হসপিটালের মোজাইক করা ফ্লোরে হাইহিল জুতা পড়ে রঙ্গিন ফাইল হাতে খটখটিয়ে হাটার কথা, সে মেয়েটি এখন হাড়কাঁপানো শীতের সকালে খালি পায়ে গোবরের স্তূপ আনা-নেওয়া করছে। কলিতেই কর্তন করা হচ্ছে ফাতিমাদের স্বপ্ন।
করোনাত্তর বর্তমান পরিস্থিতিতে ফাতিমাদের মতো অনেক মেয়েকেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
আশ্চর্যের বিষয় ফাতিমাদের এহেন আকুতি ও চোখের পানি আমাদের বাবাদের টলাতে পারছে না.......
received_337874018237350.jpeg

Sort:  

Onk shopnoi muche jay, ar onk shopnor kul khuje pawa jayna. Koto kotha, koto shopno ekhono baki.

A very good one. Keep it up, bro.