শরীর ও মন- এ দুটি সত্তার মেলবন্ধনে আমরা একেকজন পরিপূর্ণ মানুষ। তবে বাস্তবতা হলো আমরা শারীরিক বিষয়াদি সম্পর্কে যতখানি সচেতন ও উদগ্রীব থাকি, মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আমরা ঠিক ততখানি উদাসীন ও অসচেতন। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার পেছনে মানসিক স্বাস্থ্য কিভাবে প্রচ্ছন্ন ভূমিকা রাখে সে বিষয়ে আমরা খুব বেশি সজাগ নই। প্রযুক্তির কল্যাণে অতীতের তুলনায় আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়েছি এটি যেমন সত্য, প্রযুক্তির নেতিবাচকতার প্রভাবে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য অনেকখানি বিবর্ণ হয়েছে সেটিও সত্য। এ বিষয়ে কয়েকটি পর্বে কিছু লিখার পরিকল্পনা রয়েছে। আজকের এই পর্বে কিভাবে প্রযুক্তি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিবর্ণ প্রভাব ফেলছে সে বিষয়ে ফোকাস করতে চাই। চলুন শুরু করা যাক-
(ছবিটি সংগৃহীত)
সামগ্রিকভাবে প্রযুক্তি একটি বিরাট বিষয় এবং এর নানামুখী ব্যবহার রয়েছে। তার মধ্যে প্রযুক্তির যে অংশ আমাদের সবার জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে তা হল- আমাদের স্মার্টফোন, ট্যাব ল্যাপটপ, কম্পিউটার ইত্যাদি। আর এই ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে সবার জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমগুলো। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে এই মাধ্যমগুলোর নেতিবাচক প্রভাব দিনের পর দিন অব্যাহত থাকলেও আমরা এ বিষয়ে সতর্ক হচ্ছি না। পদত্যাগ করার আগে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডেন্ট শন পার্কার এক সম্মেলনে বলেছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তৈরি করা হয়েছিল মানুষকে বিচ্ছিন্ন করতে, এক সুতোয় বাঁধতে নয়। তার কথা থেকে এটি এক রকম স্পষ্ট যে ব্যবহারকারীর মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই ফেইসবুক তার ব্যবসায়িক মডেলটি সাজিয়েছে। চলুন দেখে নেয়া যাক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিভাবে আপনাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে-
১। ধরুন আপনি ফেসবুকে স্ক্রলিং করছেন। হঠাৎ আপনার চোখে পরলো আপনার বন্ধু, আত্মীয় অথবা প্রতিবেশীদের কেউ একটি সুন্দর জায়গায় ঘুরতে গেছেন। এতক্ষণ কিছু মনে না হলেও এখন আপনার মনে হচ্ছে আমি যদি যেতে পারতাম! এতক্ষণ যে আপনি কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন-ই না, সেই আপনিই এখন ভাবছেন আমি কেন ঘুরতে যেতে পারছিনা!
২। আপনার একজন ফেসবুক ফ্রেন্ড রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবারের ছবি দিয়েছে। এটা দেখে আপনি চিন্তা করতে শুরু করেছেন আপনি সর্বশেষ কবে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন। একটু আগে না ভাবলেও এখন আপনি ঠিকই সেটা ভাবছেন।
৩। আপনি একটি পোস্ট করেছেন। পোস্ট করার আগে ছবিগুলোকে খুব ভালোভাবে এডিট করেছেন এবং অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা ক্যাপশনও দিয়েছেন। কয়েকজন হাসির রিঅ্যাক্ট দিল আর এমন মন্তব্য করল যা আপনার ভাল লাগল না। আপনার কষ্ট পাওয়ার উপলক্ষ তৈরি হল, আপনি কষ্ট পেতে শুরু করলেন!
৪। আপনার খুব কাছের বন্ধুদের কয়েকজন একটি জায়গায় ঘুরতে গেছে এবং ক্রমাগত ছবি আপলোড দিচ্ছে। তারা ঘুরতে যাবে সে কথা কেন আপনাকে বলে নি আপনি সেই চিন্তায় অস্থির!
৫। ফেসবুকের পোস্ট অথবা কমেন্টে কেউ আপনার সম্বন্ধে অকারণ হাসাহাসি করছে। এবার আপনি তাদের সাথে অফলাইনে সে বিষয়ে তর্ক, তারপর মারামারি শুরু করলেন।
৬। আরেকজনের চেয়ে আপনার ছবিতে কম রিয়েক্ট পড়েছে। আপনাকে হতাশা গ্রাস করছে!
৭। স্ক্রলিং করতে করতে আপনার চোখের সামনে একটি দৃশ্য বা ছবি চলে এলো, ভেতরের বন্যতা আপনার ব্রেইনে একটা বার্তা পাঠালো। আপনি এখন অন্য কিছু ভাবছেন। হয়তো বসে আছেন কাজের টেবিলে, ভাবছেন অন্য কিছু।
৮। পড়ার টেবিলে পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হল এক মিনিট ফেসবুকে ঘুরে আসি। সেই এক মিনিট কয়েক ঘন্টা পর শেষ হলো। এতক্ষণে পড়া জমে গেছে অনেক, হাতে সময় কম। পরীক্ষার আগে সিলেবাসটা আর শেষ করা হলো না। দুশ্চিন্তা বাড়ছে!
৯। দীর্ঘ সময় মোবাইলে কাটানো বাবা-মা পছন্দ করেন না। আর আপনি এটা ছাড়া চলতে পারছেন না। এ নিয়ে বাবা-মা আপনার উপরে বিরক্ত, সেই রেশ ধরে সম্পর্কের অবনতি। ইদানিং বাবা-মা আগের মত ভালবাসন না। একা একা লাগে!
এরকম আরো শত শত উপায়ে তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাদের বিষন্নতা, অস্থিরতা,অবসনতা ও হতাশা তুঙ্গে তুলছে। আমরা কখনো বুঝতে পারছি, কখনো পারছি না। সময় এগিয়ে যাচ্ছে। অংকের খাতার মত বয়সের হিসাবটা লম্বা হচ্ছে।
এভাবেই কি সময়টা কেটে যাবে?