বাবার শিক্ষা

in BDCommunity4 years ago

আমার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। সে সময় আমার অতিবাহিত হয়েছে পরিবারের সাথে। বাবা ছিলেন গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একজন। শহর থেকে প্রায় ২০ কিমি অদূরে জনমানবহীন এলাকায় বাবা একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। কিছুদিন পরেই বেশকিছু পরিবার আসে সেখানে বাড়ি করার জন্য। হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার। আশাপাশে বন্ধুবান্ধব কিংবা খেলার সাথি তেমন একটা ছিল না। তাই খেলার সুযোগ কিংবা বাইরে যাওয়ার সুযোগ কম হতো। বন্দি জীবন থেকে রেহাই পেতে প্রায় শহরে যাওয়ার সুযোগ খুঁজতাম। এরই মধ্যে শিখেছি নতুন বাইক ড্রাইভিং।
SAVE_20201111_220956.jpg

Image

একদিন শহরে ছিল বাবার মিটিং। বাজার খরচ ও কেনাকাটার জন্য বাবা আমাকে নিতে চাইলে একবাক্যে রাজি হয়ে যাই। মা নানান জিনিসপত্রের লিস্ট হাতে ধরিয়ে দিলেন৷ শহরে পৌঁছার পর বাবা আমাকে মায়ের দেয়া লিস্টের জিনিসপত্র ও বাইকের টুকিটাকি কাজ সেরে নিতে বললেন। এবং ঠিক সন্ধ্যা ৬ টায় মিটিং রুমের সামনে ফিরতে বললেন। দ্রুত কেনাকাটা সেরে আমি সরাসরি চলে গেলাম মুভি দেখিতে।

মালেক আফসারী পরিচালিত সালমান শাহ্'র অভিনিত মুভি 'এই ঘর এই সংসার'। মুভি দেখতে দেখতে এতোটাই বিভোর হয়েছিলাম যে, বাবার কথা মন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ বাবার কথা মনে হতেই আমি চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে পাঁচটা বাজে। ঝড়ের বেগে গ্যারেজে যাই। গাড়ি নিয়ে রুমের সামনে যেতে যেতে ঘড়ির কাঁটা ৬.৪০ এ আঘাত করে।

আমাকে দেখেই বাবা চিন্তিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, দেরি হলো কেন? কোথায় ছিলাম এটা বলতে লজ্জা পাবো তাই উত্তর দিলাম- বাইক রেডি হয়নি। তাই দেরি হলো। আর ও জায়গায় বাইক দিও না কোনোদিন।

বাবা মাথাটা নিচু করে বললেন, তোমাকে বড় করেছি সত্যি কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তোমাকে সত্য বলার সাহস দিতে পারিনি। কোথাও একটা ভুল হয়েছে। জানিনা সে শিক্ষা দিতে পারবো কি না! এই বলে বাবা ভাঙ্গা ও অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তা হাটতে শুরু করলেন। এদিকে আমি গাধাটা বুঝতেই পারিনি আমার গ্যারেজে পৌঁছার আগেই বাবা ফোন করেছিলেন।

বাবা সামনে হাটছেন। আমি পেছনে বাইক নিয়ে ছিলাম। প্রায় চার ঘন্টার রাস্তায় বাবা কতটা কষ্ট করেছেন এবং ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তা আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি। পথে মাঝে মাঝে একটু বিশ্রাম নিয়েছিলেন কিন্তু আমার দিকে একবারও তাকাননি। আমিও বাবার সাথে একটা কথা বলার সাহস পাইনি। লজ্জা কি জিনিস, সেটা সেই দিন বুঝেছিলাম। বাড়ি পৌঁছাতেই দেখলাম সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিলো। বাবা উঠানে প্রবেশ মাত্রই ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। না জানি কি হয়! কিছুক্ষণ পর বাবা পানি চেয়ে মা'কে ডাকলেন। মায়ের দেয়া পানি আমি নিয়ে যাওয়ার সাহস পর্যন্ত পাইনি সেদিন। বাবা গত হয়েছেন প্রায় দশ বছর হলো কিন্তু দৃশ্যটা আমার চোখে এখনো ভেসে বেড়ায়।

বাবার পেছনে হাটার সময় এবং সেই নির্ঘুম রাতে সৃষ্টকর্তার নিকট বহুবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রার্থনা করেছি, প্রতিজ্ঞা করেছি জীবনে আর কখনো মিথ্যা বলবো না।