প্রায় ছয় মাস পর এখানে এসে লিখতে বসলাম। ছয় মাস! বিশাল এক গ্যাপ! শুরুতে শুরুতে না লিখার জন্য বেশ গিলটি ফিল হতো। এত দিন পর এসে জীবনে একটু যখন থিতু হলাম, ভাবলাম আবার লেখা শুরু করা উচিত। কাজের সুবাদে প্রতিদিনই নানা জিনিস লিখতে হয়, কিন্তু দিন শেষে ওই নিজের জন্য লেখা হয়ে উঠে না। সেই অভাব পূরণ করতেই আবার পুরোনো অভ্যাসে ফিরে আসা!
পোস্টগুলা ঘেটে দেখলাম শেষের দিকে মেঘালয় কাহিনী নিয়ে লিখছিলাম। সিরিজটার লাস্ট পোস্টটা ড্রাফটে জমা ছিল, আলসেমিতে পাবলিশ আর করা হয়নি। ছয় মাস পর সেই পুরোনো পোস্ট পাবলিশ করার পেছনে কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না, তবুও সিরিজটা না শেষ করে নতুন কিছু নিয়ে লিখতে মন সায় দিচ্ছে না। তাই মেঘালয়ের শেষ পর্ব দিয়েই নতুন করে আবার শুরু করা যাক! (ক্ষমাপ্রার্থী!!)
আজকে মেঘালয়ে আমাদের শেষ দিন। শিলং থেকে লাইতলাম নামে একটা স্পট আছে, সেটা দেখে সোজা ডাউকি চলে আসবো। লাইতলাম শিলং এ খুবই চমৎকার একটা স্পট৷ ট্যুর গাইড এই জায়গা দেখানোর জন্য শুরু থেকেই বেশ এক্সাইটেড ছিল। তো দেরি যাতে না হয় তাই আমরা একদম সকাল সকালই নাস্তা না করে হোটেল ছেড়ে বের হয়ে গেলাম। লাইতলামের পাশেই কিছু খাবারের দোকান আছে, সেখানে নাস্তা করার প্ল্যান। কিন্তু বাস থেকে নেমেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। as usual, সেই আগের মতনই বৃষ্টি, সাথে ভয়ংকর মেঘ। একদম কিচ্ছু দেখার উপায় নাই। নাস্তা খাওয়া মিলায় প্রায় এক দেড় ঘন্টার মতন থাকা হয়েছিল, যদি একটু মেঘ সরে, কিন্তু ভাগ্য সায় দিল না। কিছু দেখার সৌভাগ্য হলো না।
(কে বিশ্বাস করবে এই মেঘের ওপারেই ভয়াবহ সুন্দর সেই লাইতলাম!)
হোটেল ছাড়া তো আমাদের ইন্টারনেট ইউজ করার উপায় নাই। ৩ দিনের জন্য যাচ্ছি বলে আর সিমও কিনি নাই। তো ফেরার পথে পাবলিক টয়লেট হয়ে আসছিলাম। টয়লেটে টাকা নেয়ার দায়িত্বে এক ১০/১২ বছরের পিচ্চি। গভীর মনোযোগ দিয়ে বসে ফোনে গেম খেলছে। তো আমরা ওয়াসরুমে যাওয়ার পর খালু সেই পিচ্চির সাথে একটু ভাব জমানোর চেষ্টা করলো।
: ক্যয়া খেলরাহা হো? পাবজি?
: উহু, ফ্রি ফায়ার (ফোন থেকে মুখ না তুলেই)
: থোরা ডেটা মিলসাকতেহে ক্যয়া? হটস্পট সে?
: উহু (স্টিল মুখ না তুলেই ছেলেটা না করলো)
: রুপি ভি দিউংগা (করুণ আকুল আর্তি!)
: মুখ না তুলে এখনও সে আগের মতনই খেলায় মগ্ন।
একটুখানি ডেটার জন্য এত রিকুয়েষ্ট করেও ম্যানেজ করতে না পেরে খালুর মন হালকা খারাপই হলো।
খালুর হতাশ চেহারা দেখে এদিকে আমরা তিন জন না হেসে পারলাম না। ঊনার জন্য মায়াই লাগলো :3
মেঘের জ্বালায় লাইটলুম না দেখতে পারার দু:খ নিয়েই এরপর ডাউকির জন্য যাত্রা শুরু হলো। মেঘালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছি, মনটা একটু একটু খারাপ। রাস্তার দুপাশে উঁচুনিচু সবুজ ঘাসের পাহাড় আর টিলা। জায়গাটার নাম জোয়াই ভ্যালি।
পাহাড়গুলায় একদম সমান সাইজের ঘাস দেখে মনে হচ্ছিল পুরো জায়গা জুড়ে সবুজ জাজিম পাতা। ওয়ান লেনের পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে গাড়ি একবার উপরে উঠছে, একবার নিচে। পাহাড়ের গা ঘেষে যাওয়াতে মিনিটে কয়বার যে গাড়ি বাক নিচ্ছে তার ইয়াত্তা নাই। এতদিন পরে এসেও চোখ বন্ধ করলে মাঝে মাঝে সেই বৃষ্টি ভেজা চকচকে রাস্তায় চলে যাই। ট্যুরে যাওয়ার অনেকগুলা সার্থকতার মধ্যে একটা হলো- একবার ঘুরে এসে সেই আনন্দ সারাজীবন মনের কোনায় রেখে দেয়া যায়, সুযোগ পেলেই সেখান থেকে এক ফাঁকে ঘুরে আসা, একই আনন্দ বার বার উপভোগ করা। এই শান্তি খুব কম জিনিসেই মিলে।
দুপুরের মধ্যে ডাউকি পৌছালাম৷ আজকের জন্য পাহাড়ে হাইকিং, ঝর্ণা, জিপলিং আর স্বচ্ছ পানিতে বোটিং। পাহাড়ে উঠতে উঠতে দেখলাম কিছুক্ষণ পরপরই ছোট ছোট ঝরণা। পাশে ডাউকি লেকের বিশাল এক ফলস। পাহাড়ে যতক্ষণ হাইকিং করছিলাম পুরোটা সময়ই পানির শব্দে চারপাশ মুখরিত। কিছুক্ষণ পর পরই থেমে থেমে সেই ওয়াটার ফলস দেখছিলাম। এত সুন্দর কিভাবে হয়!
কিছুদূর হাইকিং করার পর দেখি জিপলাইনিং করার জন্য লাইন ধরে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আমার মাথায় আবার সেই প্রতিটি রুপি উসুল করার থিউরি ঝিলিক দিয়ে উঠলো। পাহাড় বাওয়া বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।
খালা আবারও আগের মতন সতর্কবার্তা দিয়ে বার বার জিগ্যেসা করছে, "আসলেই যাচ্ছো? এটা না করলে কি এমন হবে, দেখো আমরা কেউ করছি না।" কিন্তু আমি অনড়। এর আগের বার ইন্ডিয়া এসে একটুখানির জন্য প্যারাগ্লাইডিং মিস করেছিলাম, সেই আফসোস এখনও আছে। এখন জিপলাইনিংটা মিস দিলে আফসোসের লিস্টে আরও একটা জিনিস যোগ হবে। কি দরকার? জীবন তো একটাই!
মেলা সময় ধরে লাইনে দাঁড়ায় থেকে অবশেষে আমার পালা আসলো৷ হার্নেস পরায় দেয়ার সময় একটু ভয় লাগা শুরু হলো। কিন্তু এক্সাইটমেন্টের থেলায় ভয় বেশি একটা সুবিধা করতে পারলো না। একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম রেডি। ভয় ছিল, ঝুলতে গিয়ে আমার স্টেপের স্যান্ডেল মাঝপথে লেকের মধ্যে না পড়ে যায়! আমার সবে ধন নীলমণি। এরপর খালি পায়ে ঢাকায় ব্যাক করতে হবে!
কিন্তু আমাকে ছেড়ে দেয়ার পর জুতার টেনশন, ভয় সব চিন্তা একসাথে গায়েব! যেই লেকের দিকে সারাক্ষণ তাকায় ছিলাম তার উপর দিয়ে জিপলাইনিং! পাশে ঘন বন জঙ্গল। আমার তো দুই হাত খুলে ঝুলে যেতে ইচ্ছা করছিল, তবে অতটা আর সাহসে কুলায় নাই। এই অনুভূতিকে কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না! কিচ্ছু না!
(এই ঝর্নার উপর দিয়ে জিপলিং করা হয়েছিল, জিপলিং করার সময়ে ফোন পকেটে রাখার রিস্ক নেই নাই বলে কোনো ছবি তোলা হয় নাই)।
প্রায় যখন শেষের দিকে চলে এসেছি তখন হুট করে দড়িতে কিছুর সাথে একটা ধাক্কা খেলাম। মনে হলো কোমর থেকে কোন একটা দড়ি হয়তো ছুটে পড়ে গেলো। আমি ভয়ে যতটা সম্ভব টাইট করে আংটা ধরে থাকলাম। নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম যে আর ১০টা সেকেন্ড। এইটুক কোনমতে যেতে পারলেই শেষ। অলমোস্ট চলে আসছি। কয়েক সেকেন্ড পর এই ধরণের ধাক্কা আরও চার পাঁচটা খেলাম। আমার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া। এরপরে বুঝলাম এগুলা আসলে স্প্রিড ব্রেকার। যেহেতু অনেক স্পিডে আসা হয় তাই হাফ ওয়েতেই কয়েকটা লোহার রোলিং স্প্রিড ব্রেকার দিয়ে রাখা হয়। যাতে সহজে থামানো যায়। আই উইশ জিনিসটা শুরুতেই বলে দিত! তাহলে মাঝ পথে এসে দড়ি ছুটে যাওয়ার ভয় নিয়ে বাকিটা যেতে হতো না।
জিপলাইনিং শেষে কাদা পাহাড় বেয়ে নেমে লেকের উপর দিয়ে পানি মধ্যে দিয়ে পার হতে হয়। জুতা হাতে নিয়ে পানিতে পা দিয়েই সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলো। এত আরামের ঠান্ডা পানি! এত শান্তি!
কিন্তু পানির এত স্রোত ছিল যে মনে হচ্ছিল একটু অসতর্ক হলেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তাই খুব সাবধানে শেওলা পাথরে পা ফেলে ফেলে আগাতে হচ্ছিল। আসার সময় দেখছিলাম আমার বোন নদীর ওই পাড়ে গালে হাত দিয়ে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কারণ এই জিপলাইনিং করতে গিয়ে প্রায় ৪০/৫০ মিনিটের মতন টাইম লেগেছিল। বেচারার এই টাইমটাতে কিছু করার ছিল না। আমাকে রেখে স্বচ্ছ পানিতে ও বোটিংটাও করতে পারে নাই। বিগ লস। পরে একসাথে আবার হাইকিং করে ফেরার পথে ওকে কয়েকটা সুন্দর ছবি তুলে দিলাম। আশপাশ এত ভালো লাগছিল যে একদমই আসতে ইচ্ছা করছিল না।
ট্রাভেল এজেন্সির সাথে যাওয়ায় কিছুক্ষণ থেকেই আমাদের ফেরার জন্য রওনা দিয়ে দিতে হয়েছিল। ভাবছি এর পরেরবার যখন যাবো নিজেরা সব প্ল্যান করে যাবো, এটলিস্ট মন মতন দেখে ঘুরে আসা যাবে! প্রতিটা স্পটে দিয়ে তাড়াহুরা ভাবটা থাকবে না।
এতদিন পরে এসেও যখনই মেঘালয়ের ছবিগুলা দেখি, মন যতই খারাপ থাকুক, এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। আবার ঘুরে আসার জন্য মন আনচান করে। ট্রাভেলিং এর সার্থকতা হয়তো এখানেই!
আত্মারাম খাঁচাছাড়া! হা হা আসলেই তো প্রচুর ভয়ের ব্যাপার।
যদি উলটায় পড়তাম তাহলে খুঁজে পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না, নিজে ঘন জঙ্গল তার ভেতর পানি। সেই জন্য ভয়টাও বেশি ছিল!
লজ্জা শরমের মাথা খেয়েই বলি ছেলে মানুষ হয়েও আমার উঁচু প্রচন্ড ভয় লাগে।আমি হলে সাহস করতাম কিনা জানি না।