বাংলোর সামনের অংশ
বাংলাদেশের টি এস্টেটগুলা ব্রিটিশ আমলে গড়ে তোলা। চা বাগান ঘিরে এরিয়াটাকে টি এস্টেট বলা হয় কারণ এটা তথাকথিত “স্টেটের” মতনই স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোনকিছুর প্রয়োজন হলে টি স্টেটের বাইরে খুব একটা যাওয়ার দরকার পড়ে না। টি স্টেটের নিজস্ব স্কুল থেকে শুরু করে মেডিকেল, ডক্টর, দোকানপাট সবকিছুরই ব্যবস্থা করা আছে। সিলেটের হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানও অনেকটা এমনই। ম্যানেজারের বাংলোর পাশেই আছে প্রাইমারি স্কুল, সাথে মেডিকেল, ডাক্টার বাবুর বাংলো এবং তাদের স্টাফদের থাকার জায়গা। আজকে বলবো এই টি স্টেস্টের ভেতরকার কাহিনী নিয়ে।
ছোটবাবুর বাংলো
চা বাগানের ম্যানেজারদের বাংলোগুলো দেখার মতন করে তৈরি করা। এতটাই বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি করা যে বাড়ির এক মাথা থেকে আরেক প্রান্তে যেতে হাঁপিয়ে উঠতে হয়। এমনিতে সিলেটের ওয়েদার তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা থাকার কারণে ব্রিটিশরা বাড়িগুলাতে চিমনির ব্যবস্থা করে রেখেছিল, যেগুলা এখনও একটিভ! আর তখনকার সময়ে এমন ভাবে বাড়ি বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল যেখানে বাসার ভেতরে অটো ভেন্টিলেশন সিস্টেম কাজ করবে। উপরে টিন থাকা সত্ত্বেও বাইরে থেকে ঢোকা গরম বাতাস ভেতরে এসে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এই সিস্টেমটা করা হয়েছে মূলত ছাদে পার্টিশন দিয়ে।
আর বাসার ফ্লোরও এমন ভাবে সিমেন্ট দিয়ে বানানো যেটা অল টাইম ঠান্ডা থাকবে। তবে সব থেকে অবাক লাগবে ওয়াসরুমে গেলে! একেকটা ওয়াসরুম এখনকার ঢাকার মাস্টারবেডের সমান! পাহাড়ি এলাকা বলে ওয়াসরুমে দুইটা করে দরজা থাকে। একটা দিয়ে বেডরুম থেকে ঢোকা যায় আরেকটা বাসার বাইরে বাগান দিয়ে। বাইরে দিয়ে ওয়াসরুমে দরজা দেয়ার দুইটা রিজন আছে। এক পাহাড় থেকে এসে ময়লা জুতা নিয়ে ডিরেক্ট ওয়াস করা যাবে, দুই প্লাম্বার বা ক্লিনার যাতে বেডরুমের এক্সেস ছাড়াই ওয়াসরুম ক্লিন করে দিয়ে যেতে পারে। ক্লিনারের কথা বলতে গিয়ে মনে পরলো, ম্যানেজারদের স্টাফ নিয়ে কাহিনী না বললে মজার একটা পার্ট মিস হয়ে যাবে!
বড়বাবুর বাংলো
ম্যানেজার আর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার প্রত্যেকের জন্যই আটজন করে স্টাফ বরাদ্দ থাকে। এর মধ্যে আছে পারসোনাল বাবুর্চি, বেয়ারা, মালি, চৌকিদার, ধোপা এবং প্লাম্বার। টি এস্টেটের রাজা হিসেবে দেখা হয় ম্যানেজার এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে। তাদেরকে ভেতরে ডাকা হয় বড় বাবু আর ছোট বাবু বলে। সর্বেসর্বা বলে তাদের ট্রিট্মেন্টও করা হয় বাদশাহী স্টাইলে। স্টাফরা বয়সে অনেক বড় হলেও নিয়ম হলো তাদের নাম ধরে ডাকা। আমরা যেখানে কাজের মানুষদের খালা-মামা-ভাই বলে অভ্যস্ত ওখানে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়তে হয়! আমি শেষ পর্যন্ত কোনভাবেই বেয়ারাকে নাম ধরে বলতে পারি নাই!
সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো, বেয়ারা যাবতীয় সব কাজ করে দেয়। সব কাজ বলতে সব! মশারি টাঙ্গিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে বিছান করে দেয়া, জুতা সাফ করে দেয়া, প্রতিবেলায় খাবার টেবিলে বেড়ে দেয়া, থালা বাসন ধুয়ে দেয়া আন্ড দ্য লিস্ট গোস অন! আমি তো স্বপ্নেও ভাবতে পারি না যে আমার এমনও একজন স্টাফ থাকতে পারে যে মশারি পর্যন্ত টাঙ্গায় দিবে! টি এস্টেটে বড় পদে জব পাওয়া মানে রাজকীয় ভাবে থাকার সুখ পাওয়া!
আর এত সম্মান ধরে রাখার জন্যও সেভাবে ওখানে চলতে হয়। কারণ কিছু একটা উলটা পালটা করলেই পুরো টি স্টেটে সেই কাহিনী রটে যায়। যেমন চাইলেই বড়বাবু চায়ের দোকানে বসে চা খেতে পারবে না, চা বাগানের শ্রমিকদের বাড়ি যেতে পারবে না, স্টেটে শ্রমিক বা কর্মচারীদের সাথে আড্ডা দেয়া যাবে না, নিজের জিপগাড়ি ছাড়া রিকশা বা অটো এসবে চড়া যাবে না এমন আরও কত কি নিয়ম!
এধরণের হাইয়ারারকি লাইফস্টাইল লিড করতে করতে নিজেদের পারসনালিটির মধ্যেও নিজের অজান্তেই একটা কর্তিতপূর্ণ মনোভাব চলে আসে।
তবে এত আয়েসি চাকরির মধ্যেও যে ইস্যু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সেটা হলো ছুটি নেয়া। এখানে চাইলেই স্টেশন লিভ করা যায় না। এমন কি ছুটির দিনেও না। ঢাকা বা আশেপাশে কোথাও যেতে হলে স্পেশাল পারমিশন লাগে। তাও সেটা বেশিদিনের জন্য নেয়া যায় না।
আচ্ছা এখন একটু ভুতুড়ে কাহিনীর দিকে আসি। ছোটবাবুর এত বড় বাংলোবাড়ি, আর গা ছমছমে নির্জন এলাকায় তেনাদের নিয়ে কাহিনী থাকবে না এমন তো হতে পারে না! তবে এই ধরণের কাহিনী যে আমরা নিজেরাই এক্সপেরিয়েন্স করবো এটা অন্তত ভাবি নাই!
এমনিতে এসব বাংলোতে দুইটা করে বেডরুম থাকে। আমাদের গ্রুপের মেয়েরা আর ছেলেরা দুইটা রুম ভাগ করে নিয়েছিলাম। রাতে সোয়া একটার দিকে হুট করে আমার ঘুম ভাঙ্গলো। আমাদের রুমের মধ্যেই একটানা খুব জোরে জোরে টেক্কা টেক্কা করে আওয়াজ হচ্ছে। শুনে বুঝলাম তক্ষক ডেকে চলছে। তক্ষকের ডাকের সাথে আগে থেকে পরিচিত ছিলাম বলে তেমন একটা ভয় পাই নাই তাও একটু গা ছম ছম করছিল। আমার পাশের দুইটা তখনও গভীর ঘুমে। তক্ষকটাকে দেখার জন্য উঠে বসার সাথে সাথেই সে ডাক থামায় দিল। এই জিনিসটা আরও বেশি ভয়ের ছিল কারণ এত দূর থেকে ওর বুঝার কথা না যে আমি উঠে বসেছি। তো থেমে যাওয়ার পর আমি দোয়া টোয়া পড়ে ঘুমায় যাওয়ার ট্রাই করি।
পরের দিন সকালের কাহিনী। নাশতা খাওয়ার টেবিলে বসে আমার হাসবেন্ড আমাকে জিজ্ঞেসা করছিল, “তুমি কি কালকে ভোররাতের দিকে আমাদের রুমে আসছিলা?” আমি বললাম "না তো, কেন?" ও তখন “এমনি” বলে চুপ হয়ে গেলো। পাশের চেয়ার থেকে ছোটবাবু বলছিল, “ভাই কিছু দেখে থাকলে বলতে পারেন, প্যারা নাই, আমিও টুকটাক মাঝে মধ্যে এসব ফিল করি”।
এটা শুনে ও তখন বলা শুরু করলো, “কালকে রাতে তিনটার দিকে হুট করে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মনে হলো রুমের দরজা খুলে হুট করে জোরে জোরে কেউ ঘরে ঢুকলো, আবার সে রকম স্পিডেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো। পরে রাফার কথা ভেবেও আবার বাদ দিয়ে দিলাম কারণ এমন রাতে এত জোরে ওর হাটার কথা না। এজন্যই সিওর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেসা করলাম।”
ছোটবাবু তখন বললো “এমন কাহিনী আমিও মাঝে মধ্যে দেখি, রাতে কিছু একটা আসে, আবার চলে যায়। শুধু এটা না, দেখা যায় আমি রাতের বেলা মেইন দরজা বন্ধ করছি, ঠিক তখনই বাসার পিছনের দরজাও লাগানো বা খোলার শব্দ হয়। এমনও হয়েছে যে পেছনের দরজার শব্দ হওয়ার সাথে সাথেই আমি দৌড়ে দেখতে গিয়েছি, বাট কখনওই কিছু থাকে না।
আবার এই মেইন গেট বরাবর কেউ ঘুমালেও সকালে উঠে দেখে যে ও রুমের কোন একটা কর্নারে চলে গেছে। গেটের সোজাসুজি কেউ ঘুমাতে পারে না। এটা আমিও ট্রাই করে দেখেছি, গেটের বরাবর শুয়ে প্রতিবারই ঘুম থেকে উঠে নিজেকে আলাদা জায়গায় আবিষ্কার করেছি।”
ওর কথা শুনে মনে হচ্ছিল এত বড় ভুতুড়ে বাসায় এই ছেলেটা একলা কিভাবে থাকে?! কতই না সাহস লাগে! ও তখন বললো, “আসলে আপু যদি এসব মেনে নিয়ে সাহস না দেখায় চলতে পারি তাহলে এই চাকরি আমার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। এমন অনেকেই আছে যারা এই পোস্টে এসে এক দুইমাস পর জব ছেড়ে দিয়ে চলে যায়, ভয়ে কাজ করতে পারে না। আমাকে ইন্টারভিউর সময়েও জিজ্ঞেসা করেছিল, একলা থাকতে সমস্যা আছে কিনা। সেই সাহসের জোরেই এখন পর্যন্ত টিকে আছি!”
এমন কাহিনী নাকি প্রায় প্রতিটা টি স্টেটেই শোনা যায়। নাস্তা শেষে বেয়ারা আমাদের প্লেট নিতে আসলে তাকে জিজ্ঞেসা করা হলো, ভুতুড়ে কিছু সে কখনও দেখেছে কিনা। সে বললো তার বাবাও এই বাংলোতে বেয়ারা ছিল। উনি একটা কাহিনী দেখেছিল। মাঝে মাঝে এমন হতো যে ছোট সাহেব সকালে বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার জিপ গাড়ি নিয়ে ফেরত এসে বলতো নাস্তা দাও। নাস্তা খেয়ে দেয়ে চলে যাওয়ার পর পরেই আবার ছোট সাহেব এসে হাজির। বেয়ারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেসা করলে বাবু বলতো, কই আমি তো মাত্রই আসলাম! আগের জন তাহলে ছোট সাহেবের চেহারা ধরে এসে খেয়ে গিয়েছিল! আর এই ধরণের কাহিনী নাকি ব্রিটিশ আমল থেকেই হয়ে আসছে, কি অদ্ভুত!
এত কাহিনী শোনার পর বাংলোটার উপর আরও ইন্টারেস্ট বেড়ে গেলো। হ্যাঁ রাতে আর থাকার সাহস হয়তো হবে না কিন্তু একটা ফ্যাসিনেশন সবসময় কাজ করবে! দেড়শো বছরেরও বেশি বয়সের পুরনো এই বাড়ি, এমন কাহিনী কত ছোট সাহেবের সাথেই না হয়েছে, সবাই যদি লেখে যেতো তাহলে হয়তো বিশাল বড় এক বই হয়ে যেতো! কে জানে!