ঘটনা ১. ইদের দিন সকালে, গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি৷ অটোর পেছনে দুইজন বসে কথা বার্তা বলছিল। কোনো একটা কোম্পানির সেলস ডিপার্টমেন্টে কাজ করে সম্ভবত। একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। মহিলাটির কন্ঠে অভিমানের সুর। ইদের দিনও ডিউটি করতে হচ্ছে, সেজন্য। জীবনে প্রথমবার কাজের জন্য পরিবারের বাইরে ইদ করতে হচ্ছে। পুরুষ সহকর্মীটি অবশ্য উনাকে বলছিল বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য। ইদের রাতটা বাড়িতে কাটিয়ে যেন পরের দিন দুপুরের মাঝে কর্মস্থলে ফিরে আসে। বাকিটা উনি ম্যানেজ ক্ক্রে নিবেন।
ঘটনা ২. ইদের আগের দিন থেকেই প্রচন্ড বৃষ্টি। ইদের দিনের সকালে কিছুটা রোদ উঠলেও ১১ টার পর থেকে ঝুম বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতেই একদল নির্মান শ্রমিক রাস্তার পাশের এক নির্মানাধীন বিল্ডিং এর ছাদ ঢালাই এর কাজ করে যাচ্ছে। কিসের বৃষ্টি, কিসের রোদ কিংবা ইদ! তাদের কোনো ছুটি নেই। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাজ করেই যেতে হবে।
ঘটনা ৩. দুই পাশের দুই দোকানের মাঝখানে একটু ফাঁকা জায়গা। সেই ফাঁকা জায়গাতেই ৩০ থেকে ৪০ জন মানুষ চটের ব্যাগ হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে বৃষ্টি শেষ হবার অপেক্ষা করে যাচ্ছে। এই মানুষদের দলে পুরুষ, মহিলা এমনকি ছোট ছোট বাচ্চারাও আছে। বৃষ্টি শেষ হলেই তারা হাতের ব্যাগগুলো নিয়ে শহরের এদিক সেদিক, অলিতে গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে কোরবানির গরুর মাংস সংগ্রহ করার জন্য। বছরের এই একটা দিন এইসব মানুষগুলা কোনো বাড়ি থেকেই খালি হাতে ফিরে না। বছরের ঠিক এই সময়টাতেই তারা পরিবার নিয়ে এক্কটু শান্তি মতোন গরুর মাংসটা খেতে পারে। অন্য সময় তো এই সুযোগটা তেমন একটা পাওয়া যায় না।
ঘটনা ৪. আমার চাকরি জীবনের সবচেয়ে কম ছুটি পেয়েছি এবার। এর আগের প্রায় সবগুলো ইদেই ৬-৭ দিন পর্যন্ত ছুটি পেয়েছিলাম। কিন্তু এইবার মাত্র ৩ দিন। এই অল্প ছুটির কারণে মনটা ইদের দিন সকাল থেকেই খারাপ ছিল। কিনু ইদের সকালে বাসা থেকে বের হবার কিছুক্ষণের মাঝেই উপরের ৩ টা ঘটনার মুখোমুখী হবার পর থেকে নিজের প্রতি কিছুটা রাগ হওয়া শুরু হয়েছিল৷ আমি ৩ দিনের ছুটি পেয়েই মন খারাপ। অথচ অনেকে তো ছুটিই পাচ্ছে না। সেই তুলনায় আমি তো কিছুটা হলেও পেয়েছি।
বাসে বসে বসে একটা বিষয় মনে হচ্ছিল বার বার। আমরা আসলে কেউ অসুখী না৷ কিন্তু আমাদের কিছু অতিরিক্ত এক্সপেক্টেশন থাকে, যেই এক্সপেক্টেশনগুলো হয়তো হুট করে পূরণ হয় না। কিছুটা সময় লাগে। এই যেই সময় লাগাটা, এই সময়টুকুতেই আমরা মন খারাপ করে রাখি৷ তাই নিজেদের অসুখী মনে হয়।
ইদের দিনের পুরোটা সময় জার্নিতেই কেটেছে এবার। সকাল নামাজ পড়ে সোজা বাস স্টেশনের দিকে দৌড় দিলাম। এরপর টানা কয়েক ঘন্টার বাস জার্নি। গ্রামে যখন পৌছালাম, তখন বিকেল হয়ে গেছে প্রায়। ইদের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ। বাড়ি পৌছতে পৌছতে ভীষণ ক্লান্ত। কোনো রকম ভাবে সামান্য খেয়ে দেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়া মাত্রই ঘুম।
ঘুম ভেঙ্গেছে প্রায় ১১ টার দিকে। এত লম্বা সময় কিভাবে ঘুমিয়েছি, কে জানে। তবে ঘুম ভাঙ্গতেই বুঝতে পারলাম জ্বর উঠে গেছে। সকালের দিকে বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিলাম রাস্তায়৷ সেই বৃষ্টিতে ভেজাই হয়তো কাল হল। জ্বর আর তীব্র মাথা ব্যাথায় কাহিল অবস্থা। কিভাবে যে রাতটা পার হয়েছে, নিজেও জানি না।
আজ সকাল থেকে অবশ্য শরীর কিছুটা ভাল লাগছে। মাথা ব্যাথা কমে গেছে, কিন্তু জ্ব আছে। আজকের দিনটা যেমন তেমন ভাবে কাটিয়ে দিয়ে কাল বিকালে আবার শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে। পরশুদিন সকাল থেকেই আবার অফিস। ভাবলেও মনটা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কিছুই করার নেই। আজ দুপুরে একবার ভাবছিলাম একদিনের অতিরিক্ত ছুটি নিয়ে নিই। পরে ভাবলাম, থাক, দরকার নেই। ছুটি নিতে গেলে কাজ সব এলোমেলো হয়ে যাবে৷ তার চেয়ে বরং কিছুদিন পর লম্বা একটা ছুটি নিয়েই গ্রামে যাবো আবার। কর্পোরেট জীবনটা তো এমনই...