পঁচিশে জুন সকাল থেকে রহমান সাহেব খুব অস্থির হয়ে আছেন।সকালে উঠে নাস্তা সেরেই বসে আছেন টিভির সামনে।বারবার বিভিন্ন চ্যানেল পরিবর্তন করছেন।সেই পুরোনো আমলের টিভি।ঝিরিঝিরে,অনেকটা অস্পষ্ট। তার স্ত্রী রেহানা কিছুটা বিরক্ত হচ্ছেন তারপরে তার ভিতরটায় কিছুটা আবেগ মিশে আছে।তাই সেভাবে কিছুই বলছেন না।আজকে যে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন!কত তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন আজ!পদ্মা সেতুর উদ্বোধন যে আজকে।
হঠাৎ করে রহমান সাহেবের মোবাইলে ফোন এলো।তার বড় কন্যা শীলার ফোন।শীলা তার বাবা-মাকে বললো বাসায় চলে আসতে!তাদের আবার বড় টিভি কিনেছে।একসাথে সবাই মিলে বড় পর্দায় উদ্বোধনী দেখবে।মেয়ের বাসায় যেতে বললে, অন্য সময় হয়তো ইতস্তত করতেন।কিন্তু এবার সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন!জোর গলায় ডাক দিলেন।শুনলে রেহানা?তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও তো! মেয়েটা এত করে যেতে বলছে.... না করি কিভাবে?!রেহানা আচলে মুখ চেপে হেসে বললেন চলো তাইলে।।
রাস্তায় বের হতেই কেমন যেন আনন্দ আনন্দ ভাব সবার মধ্যে।বেশীরভাগ দোকান-পাট বন্ধ।কিছু কিছু খোলা আছে।তারাও তাদের দোকানের ভিতরে টিভিতে চোখ চোখ রাখছে বার বার।রিকশা ও আগের মতো খুব একটা নেই।একটা অটো রিকশা আসতেই তাতে উঠে পরলেন রহমান সাহেব।আজকে যে তার মনটা বড্ড ভালো।মেয়ের বাসায় পৌঁছাতেই কিছুটা তাড়াহুড়ো করে উপরে উঠে গেলেন।কলিংবেল দিলেন!শীলাও দরজা খুলে অবাকই হলো বাবাকে দেখে।কিছু একটা বলতে যাবে তখন রেহানা,শীলাকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন যেন কিছু না বলে।মেয়েও তাড়াতাড়ি টিভি ছেড়ে দিলেন।বড় পর্দার ছকছকে ছবি দেখে রহমান সাহেব কিছুটা খুশিই হলেন।বসে পরলেন টিভির সামনে।উদ্বোধন শুরু হলো।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন এবং তিনি প্রথম টোল প্রদান করে মাওয়া প্রান্ত থেকে যাত্রা শুরু করেন।এভাবে পরবর্তীতে সেতুটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
আসলে পদ্মা সেতু যে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের অনেক আকাঙ্ক্ষার বস্তু ছিলো।এই অঞ্চলের মানুষদের ফেরি পার হয়ে ঢাকায় আসতে হতো।ফেরি পারাপারের ভোগান্তি শুধু তারাই ভালো জানে!এমনও হয়েছে সকালে রওনা দিয়ে পরেরদিন লেগেছে ঢাকায় পৌছাতে!ফেরি জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাটা যেমন সময়ে অপচয় সাথে মালামালেরও ক্ষতি। তাই ওই দেশেগুলোর কাচামালের সহজলভ্যতা ছিলো না।তাই এই রুপ বিবিধ সমস্যার জন্য দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের দেশগুলোর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ঢাকার মাওয়া থেকে মাদারীপুর হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্ত পর্যন্ত একটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাবনা দিলেন এবং সেটা আমাদের অর্থায়নে নির্মাণ করার হবে।এভাবেই নির্মাণ হয় আমার টাকায় আমার সেতু প্রকল্প।এই প্রথম কোন নির্মাণে জনসাধারণ সবার মধ্যে তৃপ্তি দেখা গেছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে রহমান সাহেবের চোখ থেকে অনবরত পানি ঝর্ণার মতো গড়িয়ে পরছিলো।রেহানাও কাঁদছে।কাঁদবে না বা কেন?বারো-তের বছর আগের কথা,রহমান সাহেবের বড় ভাই একদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলেন।গ্রাম থেকে শহরের হাসপাতালে নেয়া হলো তারা ইমার্জেন্সি ঢাকা মেডিকেল রেফার করলো।রহমান সাহেব চাকরির সূত্রে তখন ঢাকাতেই থাকেন।তিনি তড়িঘড়ি করে লোক দিয়ে সিট ধরলেন।ডাক্তারদের সাথে কথা বলে রেখেছিলেন যে রোগী আসা মাত্রই ট্রিটমেন্ট শুরু হবে।বাঁধ সাধলো ফেরি।ফেরি পারাপারের দীর্ঘ লাইনে কিছুই যে করার ছিলো না।তার বড় ভাই এম্বুল্যান্স শুয়ে রক্তবমি করছিলেন আর কিছুক্ষণ পর পরই জিজ্ঞেস করছিলেন যে ফেরি পার হয়েছি কিনা!সেই দীর্ঘ লাইনে এক সময় জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে পরলেন আর তার শেষ নিশ্বাস আস্তে আস্তে পদ্মা নদীতে মিশে গেলো।রহমান সাহেবের একটাই আক্ষেপ ছিলো।পদ্মা সেতু তখন থাকলে অন্তত তার ভাইয়ের চিকিৎসাটা করানো যেত আর জানতে তো পারতেন ভাইয়ের কি হয়েছিলো?!
এরকম হাজারো রহমান সাহেবের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন যে এই পদ্মাসেতু!