চার ভাইবোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। প্রথম দুই বোনের বড় জনকে আমার বড়পা(বড় আপা),আর দ্বিতীয় জনকে মেঝু আপা ডাকার কথা থাকলেও আমি থাকে ভালো ভাবে ডাকলে "ছোডো", আর রাগে রাগে ডাকলে "ছোট্টরি" বলে ডাকি। আসলে আম্মা শিখিয়েছিল ছোট আপা। বর্ণ বিপর্যয় হয়ে কখন এ আশ্চর্যজনক ডাকে পরিণত হয়েছে খেয়াল করিনি।এখন কারো সামনে ডাকলে যখন জিজ্ঞেস করে কি ডাকি তখন ব্যপারটা বুঝতে পারি।
যাইহোক ডাক সমাচার আমার উদ্দেশ্য নয়।কথা আসলো তাই বলা।আমার ছোডো আহামরি কোনো সুন্দরী নয়।তবে দেখতে ভালো। এ ক্ষেত্রে আমার ফুফুর বলা একটা কথা মনে হয়ে গেল,
''কেঁচ্চোয়া সুন্দর,
কেছকেছানি পেঁচ্চোয়া সুন্দর,
কালো পেঁচার মুখটা গুলিমুলি,
এটাই আমার ভালো ''।
এটা আমাদের আঞ্চলিক ভাষার একটা কথা।'কেঁচ্চোয়া' এবং 'পেঁচ্ছোয়া' হচ্ছে বাদামি এবং কালো রং এর দুই ধরনের পাখি,যেগুলো দেখতে তেমন সুন্দর না।কালো পেঁচাও দেখতে সুন্দর না। এই কথার অর্থ নিজের জিনিস যেমন তেমনি ভালো। আর সেই জন্যই হয়ত আমার ছোডো ছিলো আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দরী। আমি ওর থেকে তিন সাড়ে তিন বছরের ছোট। আমি সব সময় ওর মতো হতে চাইতাম। ছোট বেলার অনেকটা সময় ওর সাথে কেটেছে। অনেকটা সময় বলার কারণ ছোডো যখন যষ্ঠশ্রেণিতে ওঠে তখন সে মামার বাড়ি চলে যায় পড়াশোনার জন্য। এরপর থেকে সে মামার বাড়িতেই থাকতো। যদিও স্কুল ছিল আমদের বাড়ির কাছে। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে স্কুলে আসতো আবার যেতো কিন্তু বাড়িতে আসতো না বেশির ভাগ সময়। যদিও আসতো আধাঘন্টার বেশি থাকতো না।
এ এক আজব সমীকরণ,আমার মাথায় ঢুকে না।নিজের বাড়ি থেকে স্কুলের দুরত্ব পাঁচ মিনিট হওয়া সত্ত্বেও এক ঘন্টা দুরত্বের মামার বাড়ি থেকে স্কুলে আসা যাওয়া করতো। মধ্যবিত্ত পরিবারে হয়তো এগুলোই ছোট ছোট উৎসর্গ।ছোটবেলা যতটা সময় ওর সাথে কাটিয়েছি সেটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ওর ছোট থেকে একটা অভিযোগ আম্মা আব্বা ওকে কম ভালোবাসে। আমাদের তিন ভাইবোনকে বেশি ভালোবাসে।যদিও সে আমাদের, বিশেষ করে আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তার অভিযোগ খাবার সহ সব কিছুতেই আম্মা আমাদের বেশি কেয়ার করে। অথচ ওর ভাগের খাবারের বেশির ভাগ অংশ ও আমাকে দিয়ে দিতো।
যেমন বরই এর সময় গাছ থেকে বরই পেরে আম্মা আমাদের তিন বোনকে সমান ভাগে ভাগ করে দিতো।আমার গুলো আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতাম। ছোডো ওর ভালো গুলো রেখে তুলনামূলক খারাপ গুলো আগে খেতো।তারপর যখন দেখতো আমার গুলো শেষ ওর ভালোগুলো আমাকে দিয়ে দিতো। তাই আমি তাকে একদিন বললাম ছোডো, তুই বলিস আম্মা আব্বা তোকে সব কিছুতেই ঠকায় আর তুই যে তোর জামা, কাপড়, খাবার সব আমাকে দিয়ে দিস সে বেলায়! ছোডো সেদিন বলেছিল,তুই আমার ছোট তোর জন্য প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দেব তাতে আম্মা-আব্বার কি। তারা তাদের সন্তানদের কম বেশি করবে কেন?
ছোডো কে আম্মা-আব্বা কম ভালোবাসে কিনা তা আমি জানিনা তবে আমার ছোডো প্রয়োজনে আমার জন্য জীবন দিতে পারে সেটা আমি জানি বা জেনেছি জীবনের প্রতিটা সংকটাপন্ন সময়ে। ও সাদা মনের মানুষ। যাকে বলে সহজ সরল। ওর সরলতার ছোট্ট একটা গল্প বলা যাক।
২০১৪ সালের বিশ্বকাপের সময় পড়ালেখার সুবাধে আমরা তিন ভাইবোন একসাথে থাকতাম।তখন আমাদের টিভি ড্রয়িং রুমে ছিল। বিশ্বকাপ ফুটবল মানে বেশিরভাগ বাঙ্গালির ব্রাজিল -আর্জেন্টিনা নিয়ে এক রকম বাড়াবাড়ি।আমরা ও তার বাইরে নই। ছোডো ছোট্ট বেলা থেকে ব্রাজিলের অনুসারী। আমি যখন ছোডোর অনুসারী তখন আমার পক্ষে ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু শাওন আবার আর্জেন্টিনার অনুসারী। আমার আর শাওনের এই বিপরীত মুখী অবস্থান দেখে ছোডো কোন দলের সাপোর্টার ছিল ভুলে গেছে। যেকোনো দলের সাথে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার খেলা হলে কোনো সমস্যা নেই।
তবে সমস্যা দেখা দিলো সে দিন, যেদিন ব্রাজিল আর্জেন্টিনার প্রতি পক্ষ।ব্রাজিল হেরে গেলে আমি কষ্ট পাবো আর যদি আর্জেন্টিনা হেরে যায় শাওন কষ্ট পাবে।এই চিন্তায় ছোডোর রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ফযরের সময় ওঠে টিভির ডিস খুলে রিমোট ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছে। সকাল থেকে রিমোট পাচ্ছি না। আমি আর শাওন রিমোট খুঁজি ছোডোও আমাদের সাথে খুঁজে। তাই আমরা দুজন ভাবতেও পারিনি ছোডো লুকিয়ে রেখেছে। সে দিন আমাদের খেলা দেখা হয়নি। পরের দিন সকালে দেখি রিমোট জায়গা মতো রাখা। পরে ঘটনা জানতে পারলাম। আমি অনেক রাগারাগি করলাম। শাওনের খারাপ লেগেছে কিন্তু ও রাগ করতে পারে না।সেদিন রাগ করলেও আজ বুঝি সামান্য খেলার হার জিতে আমরা কষ্ট পাব সেটা সে মানতে পারে না।
এখন সে অন্যের ঘরোনি। কিন্তু আমাদের সে একি ভাবে ভালোবাসে। আমার প্রবাস জীবনের সাত বছরে ছোডো কোনদিন ফোন দিতে ভুলেনি।হ্যালো বলার সাথে সাথে বুঝে যায় আমি কেমন আছি। আমার কাছে মনে হয় এটা তার আশ্চর্যজনক ক্ষমতা। কিন্তু ও বলে তোরা আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে আছিস। তোরা কেমন আছিস জানার জন্য তোদের কন্ঠ শুনায় যথেষ্ট। হেলাল ভাই (ছোডোর বর)প্রায়ই বলে বিয়ের পর মানুষ সংসার নিয়ে ব্যাস্ত থাকে আর মেরি(ছোডো) ভাইবোন নিয়ে ব্যাস্ত।কথাটা হেলাল ভাই যেভাবেই বলোক কথাটা সত্য।
বিয়ের এত বছর পরও ছোডো শাওন আর আমাকে নিয়েই ব্যস্ত।আমার কি সমস্যা হচ্ছে, শাওনের কি সমস্যা হচ্ছে কি হবে এর সমাধান এসব করেই তার দিন কাটে। আমার যত রাগ কষ্ট ওর উপর ঢেলে আমি হালকা হই। ও পরক্ষণে সব ভুলে আমাকে কাছে টেনে নেয়। আমার কিংবা শাওনের যদি জ্বর ও আসে, ও রোজা মানত করে বসে থাকে। এই জন্য আমি ওকে অনেক বার বকেছি তাতে কোন লাভ হয় না।ওকে দেখে আমি বুঝতে পারি ভাই বোন ছাড়া জীবন কখনো পূর্ণতা পায় না।ছোডো তোকে কখনো গলা ছড়িয়ে ধরে বলা হয়নি আমিও তোকে ভালোবাসি। জানি এই লেখাটা তুই কখনো পড়বি না তাও বলছি 'ছোডো' তোকে ভালোবাসি অনেক বেশি যা কখনও পরিমাপ করা যায় না।

Congratulations @setararubi! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s):
Your next target is to reach 100 upvotes.
You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP
Check out the last post from @hivebuzz:
Support the HiveBuzz project. Vote for our proposal!