আমাদের গ্রামের তৌফিজ ভাইয়ের একটা চা-ষ্টল আছে। তৌফিজ ভাইয়ের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। তিনি নদীর কিনারায় খাম পুতে ঝুলন্ত অবস্থায় তার চা-ষ্টল বানিয়েছেন।তার কোনো বাড়ি-ঘর নেই। তাই রাতে তিনি তার চা-ষ্টলেই ঘুমান। চা আমি খুব একটা পছন্দ করি না।
কিন্তু অবসর পেলেই আমি আলি তৌফিজ ভাইয়ের চা-ষ্টলে গিয়ে বসি। তৌফিজ ভাইয়ের চা-ষ্টলে ভিড় লেগেই থাকে সবসময়। সুড়ুৎ সুড়ুৎ রকমের একটা শব্দ ওঠে চায়ের কাপে কাপে, চুমুকে চুমুকে গল্প জমে ঠোঁটের কিনারে কিনারে— কান খাড়া করে আমি শুনি, চোখ উজ্জ্বল করে সবার তৃপ্ত মুখ আমি দেখি। তারপর আবার চা-ষ্টলে তিনি বিভিন্ন ধরনের গান বাজান। সব মিলিয়ে তার চা-ষ্টল আমার ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে।
ভাইয়ের চা-ষ্টলে একটা ব্যাপার আছে। ব্যাপারটা আমাকে খুব টানে। দোকানটাতে আমাদের এলাকার মনি চাচা যেমন চা খেতে আসেন, চা খেতে আসেন এলাকার দিলীপ জ্যাঠাও। আলহাজ ভাই যেমন আসেন, আসেন হরিহর দা-ও। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি তৌফিজ চায়ের কাপগুলোতে কেমন এক হয়ে যায় সব।
ঠোঁট।
তৃপ্তি।
বিশ্বাস।
মানুষ।
কিন্তু তৌফিজ ভাইয়ের চা-ষ্টলের বাইরের দুনিয়াটা আমার ভালো লাগে না, একদম ভালো লাগে না। আমার খুব কষ্ট হয়— যখন শুনি দিলীপ জ্যাঠার বাসায় গিয়ে পানি খেতে চাইলে মনি চাচাকে শুনতে হয়েছে— “তুমি বাপু মোসলমান, জল খাও, কিন্তু গেলাসে মুখ লাগিয়ে খেয়ো না, বাপু।” আমার খুব কষ্ট হয়— যখন শুনি আলহাজ ভাইয়ের সাথে সামান্য ঝগড়ায় হরিহর দা-কে শুনতে হয়েছে— “শালা বিধর্মীর বাচ্চা বিধর্মী!” আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কষ্ট।
এবং আমার, প্রায়ই, খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে— এই সমস্ত দুনিয়া ভেঙ্গেচুরে তৌফিজ ভাইয়ের চা-ষ্টল হয়ে গেছে, যে চা-ষ্টলের কাপগুলোতে এক হয়ে মিশে গেছে সব।
ভিন্ন ভিন্ন ঠোঁট।
ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস।
ভিন্ন ভিন্ন মানুষ।
Sort: Trending