অনেকেই বিশ্বাস করেন, মানবজাতির ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি হলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। পদার্থবিজ্ঞানের তার অবদানের কথা আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে মানুষ। ব্যক্তিজীবনে তিনি হয়ত কিছুটা খ্যাপাটে, অগোছালো আর পাগল কিসিমের মানুষ ছিলেন, এবং ছিলেন অত্যন্ত অলস আর খামখেয়ালিও, তবু বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে তার শ্রেষ্ঠত্বের কথা এক বাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য সকলেই।
এবং সেই সাথে মানুষের বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে তাঁর যেকোনো উক্তি বা অভিমতও যে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে, সেটিও নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং সেই মানুষটিই যদি বিশেষ কোনো জাতিগোষ্ঠীকে ঢালাওভাবে ‘নির্বোধ’ বলে আখ্যায়িত করেন, সে কথা মেনে নিতে যতটা না বেগ পেতে হয়, তারচেয়ে সে কথাকে প্রত্যাখ্যান করতে আরও বেশি ঝক্কি পোহাতে হয়।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, আইনস্টাইন আসলেই ‘নির্বোধ’ বলেছিলেন ভারতীয়দের! এ পর্যন্ত পড়েই যেন কেউ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মানুষকে নিয়ে হাসি-তামাশা শুরু করে পৈশাচিক আনন্দলাভের বিকৃত মানসিকতার পরিচয় না দেন। কেননা আইনস্টাইন যে সময়ে বসে ভারতীয়দের প্রতি নিজের এমন অভিমত পোষণ করেছিলেন, তখনও কিন্তু ভারতবর্ষ অবিভক্ত ছিল। অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশীরাও তার ইঙ্গিত করা ভারতের অংশীদার ছিলাম। তাই মেনে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই যে, আইনস্টাইনের বলা ‘নির্বোধ’ বিশেষণটি ভারতীয়দের জন্য যতটা সত্য, আমাদের জন্যও ঠিক ততটাই প্রযোজ্য।
সম্প্রতি আইনস্টাইনের দুইটি সফর-ডায়েরী প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো তিনি লিখেছিলেন এশিয়া ভ্রমণকালে, ১৯২২ সালের অক্টোবর থেকে ১৯২৩ সালের মার্চ মাসের মধ্যে। সে সময়ে আইনস্টাইন ভারতীয়দের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন বর্তমান শ্রীলংকার কলম্বোতে, এবং সেই সাক্ষাতের উপর ভিত্তি করে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে ভারতীয়রা ‘আদিমযুগে’ বাস করে। তাঁর মনে আরও ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে, “ভারতীয়রা ‘জন্মগতভাবে নিম্নতর’ এবং উপমহাদেশীয় জল-হাওয়ার প্রকোপে তাদের চিন্তাশক্তি এতটাই আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে যে তারা ঘন্টাখানেক আগে বা পরের কোনো বিষয়েই চিন্তাভাবনা করতে পারে না।”
আইনস্টাইন যেভাবে ঢালাওভাবে একটি পুরো জাতিকে এভাবে অবমাননা করেছিলেন, তা থেকে অনেকেরই মনে সন্দেহ জাগতে পারে যে তিনি হয়তবা জাতিবিদ্বেষী একজন ব্যক্তি ছিলেন। অথচ তিনিই কিনা দুই দশক বাদে অসাধারণ একটি উক্তি করেছিলেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘বর্ণবাদ ও জাতিবিদ্বেষ সাদা মানুষদের একটি অসুখ।’ এ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি, পরবর্তী জীবনে হয়ত তিনি তাঁর পূর্বের চরমপন্থী মনোভাব থেকে সরে এসে আরও বেশি মানবিক হয়ে উঠেছিলেন। এবং তিনি সম্ভবত নিজের বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতার কারণেই তা সম্ভব হয়েছিল। তিনি নিজে ছিলেন একজন ইহুদি, এবং নাৎসি জার্মানিদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে তিনি এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন।
অথচ এক সময়ে আইনস্টাইনের জাতিবিদ্বেষের মাত্রা ঠিক কতটা উঁচুতে ছিল, তার আরও অকাট্য প্রমাণ আমরা পাই চীনাদের সম্পর্কে তাঁর করা মন্তব্য থেকে। তিনি লিখেছিলেন, “এটি হবে খুবই দুঃখজনক একটি বিষয় যদি চীনারা অন্য সব জাতির থেকে এগিয়ে যায়। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না চীনা রমণীদের মাঝে কী এমন আকর্ষণ শক্তি রয়েছে যে বাইরের দেশ থেকে আসা পুরুষেরা তাদের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারে না?” আরেক জায়গায় তাঁর মন্তব্য, “চীনারা অনেক বেশি পরিশ্রমী কিন্তু নোংরা ও বোকা। তারা এমনকি খাওয়ার সময়ও বেঞ্চিতে বসে না।”
কলম্বোর মানুষ সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, “এখানকার মানুষ খুবই নোংরাভাবে জীবনযাপন করে, তাদের শরীর থেকে সবসময় দুর্গন্ধ আসতে থাকে। তারা কাজ করেও খুব কম, আর তাদের প্রয়োজনও হয় খুব কম।”
চিরদিন আইনস্টাইনকে অনেক বড় সম্মানের আসনে বসিয়ে এসেছেন যারা, তাঁর কলম থেকেই নিজেদের সম্পর্কে এমন নেতিবাচক ও নিচু মন্তব্য শুনে অনেকেই হয়ত কষ্ট পাবেন। উল্টো আইনস্টাইনকেও গালাগাল করতে শুরু করবেন। তবে আমাদের পরামর্শ হবে, এ বিষয়ে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখানোর আসলে কিছু নেই।
গত শতকের বিশের দশকে, যখন আইনস্টাইন এশিয়া মহাদেশে এসেছিলেন, তখনও এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই ছিল অত্যন্ত অশিক্ষিত ও বর্বর। পশ্চিমাবিশ্বের আধুনিকতার ছোঁয়া তাদের গায়ে তখনও খুব একটা লাগেনি। তাই নিজের অবস্থান থেকে আইনস্টাইন ভারতীয় বা চীনাদের সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছিলেন, সেগুলো সহ্য করার মত না হলেও, মেনে নেয়ার মত অবশ্যই।
এবং এখন আমরা গর্ববোধ করতেই পারি যে, একশো বছর আগের তুলনায় আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, সকল দিক থেকে অনেক বেশি এগিয়ে গেছি। এখন আমরা এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পশ্চিমাদেরকেও হারিয়ে দিতে সক্ষম।
তবে তাই বলে কেউ যেন আবার ভেবে না বসেন যে আইনস্টাইনের মন্তব্য বর্তমানে একেবারেই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। কারণ ভেবে দেখুন আইনস্টাইন কী বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতীয়দের চিন্তাশক্তি এতটাই দুর্বলতা যে তারা এক ঘণ্টা আগের বা পরের কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারে না। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও, এ মন্তব্য কিছুটা অতিরঞ্জিত মনে হলেও, একই সাথে যুক্তিসঙ্গতও নয় কি?
এখনও কি আমরা খুব বেশি দূরদর্শী হতে পেরেছি? পশ্চিমারা যেখানে পঞ্চাশ বছর পরের পরিকল্পনাও এখনই সেরে ফেলে সে মোতাবেক পদক্ষেপ নেয়, আমরা তখনও পাঁচ বছর পর দেশের কী অবস্থা হবে সে ব্যাপারেই কোন ধারণা রাখি না। নিজেদের ভবিষ্যতকে আমরা ছেড়ে দিয়েছি ভাগ্যের হাতে। অন্যদিকে আমাদের স্মৃতিশক্তিকেও তুলনা করা যায় গোল্ডফিশের মত। ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা তো অনেক বড় বিষয়। আমরা তো এমনকি মাসখানেক আগে কী হয়েছে সেটিও খুব সহজেই ভুলে যেতে পারি। যখন যে ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়, আমরা সেটি নিয়ে মেতে থাকি। কিন্তু ইস্যুর ডেট এক্সপায়ার হলেই আমরা সেই ইস্যুকে চিরকালের জন্য বাক্সবন্দি করে ফেলি, সেটির ফলো-আপ কী হলো, সে ব্যাপারে আমাদের যেন কোন দায়বদ্ধতাই থাকে না। এবং অতীতের ভুলগুলোর আমরা বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটাই।
তাহলে আইনস্টাইনের যুক্তি অনুসারে, এখনও কি জাতি হিসাবে আমরা অনেকটাই ‘নির্বোধ’ নই?
tar kotha thik silo tokhn kar hisebe.. now sob kisu onek change.... Aste aste aro improve hobe asa kori.
stay with me