আমার মা শারমিন আহমেদ প্রচন্ড বুদ্ধিমতী মহিলা। তিনি বাংলা বিভাগের ছাত্রী হয়েও সাইকোলজি সম্পর্কে বেশ পড়াশুনা করেছেন সেটা তিনি তার সুক্ষ্ণ কাজকর্ম দিয়ে বুঝিয়ে দেন। আমার বাবার সম্পূর্ন মনোজগতের নিয়ন্ত্রণ তার হাতে এক্ষেত্রে তার ধীর ঠান্ডা মস্তিষ্ক আর সাইকোলজির ভূমিকা অনেকখানি, আমি ঠিক করে রেখেছি হাবাগোবা মেয়ে ছাড়া বিয়ে করব না কেননা আমি চাইনা আমার মনোজগতের নিয়ন্ত্রণও অন্য একজনের হাতে চলে যাক। বাড়ির ছোট ছেলে হিসেবে আদর যত্ন বেশি পাবার কথা থাকলেও আমার বেলায় সব সময় হয়েছে উল্টোটা। আমার বড় বোন নদী, আর বড় ভাই আলিফ। পড়াশুনা শেষ করে সবেমাত্র চাকুরীতে জয়েন করেছি, বাবা তার কলিগের মেয়েকে পছন্দ করে রেখেছেন আটবছর আগে থেকেই। অবশ্য এইসব নিয়ে আমার মা বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি কখনো।
সেদিন সকালে অফিস যাবার আগে খাবার জন্য টেবিলে বসেছি ওমন সময় বাবা এসে বললেন - জাহিদ আজ অফিস যাওয়ার দরকার নেই বসকে ফোন দিয়ে বল তোমার আর্জেন্ট ছুটি লাগবে। আমি রুটিতে কামড় দিতে দিতে মায়ের দিকে তাকালাম, উনি পরম যত্নে রুটিতে জেলি মাখছেন, বাবা যে এই মুহুর্তে কিছু বললেন সেটা তিনি শুনতে পাননি বলে মনে হচ্ছে। আমি নার্ভাস গলায় বললাম- আব্বু আজ তো আমার কোন আর্জেন্ট কাজ নেই, আর এভাবে হুট করে বললেই তারা অফিস থেকে ছুটি দেবেনা। ভাইয়া খুব চুপচাপ স্বভাবের, তিনি শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন - জাহিদ, আব্বু যখন বলেছেন আর্জেন্ট তার মানে আর্জেন্ট। মানুষের চাওয়াপাওয়াকে মূল্য দিতে শেখো। তোমার বসকে কনভিন্স করার দায়িত্ব তোমার, আমাদের না। সো ইউ হ্যাভ টু ডু ইট। এরপরে আমার আর কথা বলার কিছু থাকেনা, আসলে ভাইয়া কখনো এমন ভাবে কথা বলেননি আমার সাথে তাই একটু গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছিলাম ভেতরে। ফোন বের করে বসকে ফোন দিতে যাব ওমনি আপু ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন - তোমার ন্যূনতম টেবিল ম্যানার এই বয়সেও এসে হয়নি দেখছি! ফোনটা খাবার পরেও করা যায়। কী ব্যাপার! সবাই এমন করছে কেন! যাই হোক চুপসে গেলাম, খাবার শেষে বসকে ইনিয়েবিনিয়ে বলে ছুটি নিলাম।
image @source
মেয়ে দেখতে এসেছি, মেয়ে আহামরি সুন্দর না হলেও চেহারাতে মায়া আছে বেশ। মেয়ের নামও মায়া। মাস্টার্স করছে এবার। মা শান্ত গলায় মায়াকে বললেন - তুমি কী মাস্টার্সের পরে বিয়ে করতে চাও নাকি আগে? মায়া মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে, মা আবার বললেন - দেখো চুপ করে বসে থাকলে সমাধান আসবেনা, তোমার চাওয়াপাওয়ার মূল্য দুনিয়ার সবার আগে কেননা বিয়েটা তোমাকেই করতে হবে। মায়া এবার ভরসা পেয়ে বলল- মাস্টার্স কমপ্লিট হবার পরে হলেই আমার জন্য ভাল হত, তারপরেও আমার জোরালো আপত্তি নেই। মা আপুর কাছ থেকে রিং টা নিয়ে মায়াকে পরিয়ে দিলেন, আব্বু প্যাকেটে থাকা কী একটা যেন মায়ার হাতে দিল।আব্বুর দিকে কি যেন ইশারা করলেন - আব্বু মায়ার বাবাকে বললেন- বিয়ের দিনক্ষণ আমরা পরেই ঠিক করব, মেয়ের পড়াশুনাটা শেষ হোক। সেদিনের মত বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। রাতে আপু এসে মেয়ের ফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছে আর বলে গিয়েছে এমন কিছু করবেনা যাতে আমাদের ইমেইজ নষ্ট হয়, বাবাকে ছোটলোক ভাবেন।
বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগল আমার উপর সকলের ঠান্ডা অত্যাচার ততই বাড়তে লাগল। ছুটির দিনে নামাজ পড়ে এসে বসে রয়েছি অথচ মা কিচেনে রেঁধেই যাচ্ছেন, আপু তারমত করে টিভি দেখছেন। ভাইয়া আর আব্বু মিলে দাবা খেলছেন! আম্মুকে দুবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কতক্ষণ লাগবে খাবার হতে তিনি কোন উত্তর দেননি। তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করায় উনি এসে বললেন- রান্না শেষ হলে দেখতেই পারবে, আর আমার হাত চারটে না। খিদে তোমার একার লাগেনি, ভদ্রতা জিনিসটা এখনো আয়ত্ত করতে পারোনি তুমি। ব্যাস এর পর আর কী বলার থাকে! এরপর থেকে রাতের রান্না শেষ করতে তিনি বারোটাও বাজিয়েছেন কিন্তু সেদিনের ঐ কথাগুলো শোনার পরে আর কিছু বলতে পারিনি পরবর্তীতে। অফিস থেকে একদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে মতিঝিল গিয়েছিলাম, কেন কাউকে না জানিয়ে গিয়েছিলাম সেই অপরাধে সবাইকে সরি বলতে হয়েছিল! অথচ এর আগেও আমি আড্ডা দিয়েছি, মা, ভাইয়া, আব্বু, আপু কেউ তখন এমন কড়া কথা বলেনি, শুধু
বলেছিলেন ফোন দিয়ে জানিয়ে দিতে।
সকালে অফিস যাবার আগে দেখি শার্ট ধুয়ে দেয়নি কেউ ই, আপুকে জিজ্ঞেস করলাম শার্ট ময়লা যে, কেউ ধুয়ে দেয়নি কেন? আপু ক্ষিপ্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- তুমি বড় হয়েছো, অফিস কর তাই ব্যস্ত থাকো কিন্তু দুটো কাপড় ধুয়ে দিতে দশ মিনিটের বেশি লাগে কী? বাসায় মাকে অনেক কাজ করতে হয় সারাদিনে। নিজের কাজ নিজে না করে অন্যর উপর চাপিয়ে দেয়া ছোটলোকি আর প্রভুত্ব মানসিকতার পরিচয় দেয়। আমি সেদিন কিচ্ছু বলতে পারেনি আর, অফিসে ঐ ময়লা শার্ট পরেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে সব কাপড় ধুয়ে দিয়েছিলাম। অফিসের কাজে একটা আর্জেন্ট কল করতে হত তাই এক কলিগকে ফোন দিতে গিয়ে দেখি ব্যালেন্স শেষ, ভাইয়ার রুমে গিয়ে দেখি ভাইয়া নেই। উনার ফোন দিয়ে ফোন দিতে গিয়ে দেখি ফোন লক করা। ভাইয়া ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলেন তার ফোন আনলক করার ট্রাই করছি। উনি এসে ফোন আনলক করে দিয়ে বললেন কল করতে। কথা শেষে ভাইয়ার হাতে ফোন দিতে গেলাম, উনি বললেন - জাহিদ, মানুষের কিছু জিনিস আছে যেখানে সে কাউকে জায়গা দিতে চায়না। হোক সে বাবা, ভাই, মা। এই সেলফোন একান্তই আমার, তোমার কোন দরকার পড়লে সেটার জন্য আগে আমার অনুমুতির দরকার ছিল, তুমি যা করছিলে তা চুরির শামিল। তোমার ম্যানার জানা নেই এটি সেটাই ইঙ্গিত করে।
অবশেষে আমার বিয়ে হল, অফিস থেকে বদলি করে অন্য জায়গায় পাঠালো। আজ সংসার করছি প্রায় চার বছর, মায়ার সাথে কখনো উঁচু গলায় কথা বলিনি, মায়া দেরিতে রান্না করলেও একটা আওয়াজও করিনি কেননা সেই শিক্ষাটা আমার মা আমাকে দিয়েছেন। অথচ অন্য কেউ হলে এই নিয়ে বেশ হুলুস্থুল বাধিয়ে দিত, গায়ে হাত তোলাতোলি পর্যন্ত হয়ে যায় অনেকের। মায়া আমার ধৈর্য দেখে বেশ অবাক হয়! এমনকি আমার অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলেও সে ঠান্ডা গলায় আমার দিকে চেয়ে বলে আজ অনেক জ্যাম ছিল বোধহয়, যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। মায়া কখনো উচ্চ গলায় বলেনি -প্রতিদিন আমি রাত জেগে অপেক্ষা করতে পারবোনা, কোথায় থাকো সারাদিন, কী কর তুমি সারাদিন!মায়া কখনো এই কথা আমাকে বলেনি। মায়া এই ধৈর্য্য শিক্ষাটা পেয়েছে আমার কাছ থেকেই! আমার কাপড় কেন ধোওনি! সারাদিন করোটা কী? এমন কোন প্রশ্ন গত চারবছরে একবারো করিনি মায়াকে। ও কাপড় না ধুতে পারলে আমি চুপচাপ আমার আর ওর দুজনের কাপড় একসাথে ধুয়ে দিয়েছি। কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম স্বামীর কাপড় না ধুয়ে দেবার কারনে ঝগড়া বাধিয়ে স্ত্রীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত! পরে সেই স্ত্রী আবার মামলা করেছে। কী সাংঘাতিক কান্ড ভাবা যায়!
মায়া রাতে ফেসবুকিং করলেও আমি কখনো তার স্ক্রীনের দিকে আড়চোখে তাকায়নি, তার পাসওয়ার্ড চাইনি। মায়াও আমার কাছে চায়নি, অথচ এই সামান্য ফেসবুক পাসওয়ার্ড না দেবার কারনে প্রতিদিন শতশত সম্পর্ক ভাঙ্গে! অনেকদিনের গড়া সম্পর্ক চোখের নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। এই হিসেবে আমরা বেশ ভালোই আছি, আমাকে এই শিক্ষা দেয়া হয়েছে কখনো যেন কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রভুত্ব না খাটায়। আর সামান্য এই শিক্ষাতেই আমার সংসার কত্ত গোছালো! কত্ত সুন্দর! মায়ের সাইকোলজিক্যাল টার্ম আমার বাবা, ভাই, বোন এবং আমার উপরে এসে পড়েছে বেশ ভালভাবেই! এই একটা মানুষের কারনেই আমার সংসার, ভাইয়ের সংসার, আপুর সংসার আজ খুব সুন্দর ভাবে গোছালো। অশান্তির জন্যও দুটো পক্ষ লাগে, অন্য পক্ষ অশান্তি করতে চাইলেও আমাদের ভিতরে মায়ের দেয়া শিক্ষাতে অশান্তি বেশি দূর এগোবেনা। ফলাফল অন্য পক্ষও ভাল হতে বাধ্য। আমার স্ত্রী মায়াকে প্রভাবিত করে আমার ভিতরের থাকা শিক্ষাগুলো, তার সন্তানেরাও প্রভাবিত হবে তার ভিতরে থাকা শিক্ষা দ্বারা। এভাবেই আস্তে আস্তে দেখা যাবে দুনিয়ার সর্বস্তরে শোনা যাবে
Dear friend, you do not appear to be following @artzone. Follow @artzone to get a valuable upvote on your quality post!