আমিও বাঁচতে চাই। কেমনে বাঁচতে চাই - এই ভাবনা নিজের কাছেই নিজের অসম্ভব হাস্যকর লাগে। আমি ভাবি, গল্পকার হবো। সেই আদ্যিকালের ভাবনা, তখনো পাইলট কি, ডাক্তার কি জানি না। মানুষ শুনতাম বুয়েটে EEE পড়তে চায়। আমি বুয়েট কি জিনিস, তাই বুঝতে সময় লাগছে বহুদিন; আর EEE কি জিনিস, বানান কেমন এইটা তো আরও দূরের ব্যাপার। এমনকি আমি যা নিয়ে পড়াশোনা করি, এ কি জিনিস তা মাত্র জানতাম ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। এইটা এজন্য বলা যে, আমার চাওয়া গল্পকার হওয়া, অনেক বড় কিন্তু ছোট্ট চাওয়া; লেখক ফেখক নয়, নয় কবি, স্রেফ গল্পকার হবো। হবো উপন্যাসিক। আমার এই ভালো লাগে। আমার মনে হয়, গল্পকার হতে গেলে প্রচুর দুঃখবোধ দরকার। ভাবতে বসলে, আমার সাথে কোন দুঃখই খুঁজে পাই না। আমার অবাক লাগে। আমি না সুখী, না দুঃখী। কিন্তু আমার মনে হয়, সকল দুঃখবোধ আমারে জড়ায়ে ধইরা থাকুক। সকল বিষণ্ণতা আমার কাছে জমা থাকুক। যেন এটা এক ফ্যান্টাসির দুনিয়া। কল্পরাজ্য। ভরপেট ভাত নিয়ে যে শুয়ে শুয়ে যেন এ এক অসম্ভব সুন্দর একটা কল্পনা। যেন দুঃখ ছাড়া গল্পকার, লেখক, কবি হওয়া যায় না। এ দুঃখ অন্যরকমও হতে পারে। স্রষ্টার থেকে আমার ভেতরকার মধ্যবর্তী দূরত্বের দুঃখ। তার অভাবের দুঃখ। কিন্তু আমার তাঁর প্রতিও টান কম। আমি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাঁর সাথে এ নিয়েই গল্প করি। আমার চোখে ফেচ ফেচ করে কান্না আসে। আমার কান্না আসে চাঁদ দেখলে, মায়ের কোলে বাচ্চা দেখলে, কুত্তা মরে পড়ে আছে দেখলে, মানুষের প্রেম দেখলে, চুমু দেখলে, সবকিছুতেই। আমার ভ্রান্ত চিন্তায় এও যুক্ত হয়, এরা কি আমারে শুদ্ধ করে? একদিন এরা কি শব্দে শব্দে বাইর হইয়া আসবে? আমার কলেজ জীবন কি এক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কাটাইছি, তা আমার পাশে বসে ক্লাস করা মানুষগুলাই জানে। কিছু একটা লেখার জন্য কত পৃষ্ঠা কুচি কুচি করে ফেলছি, সেটা দিনগুলা জানে।
তবু চিন্তা করে করে একটা লিখা আজও লিখতে পারি নাই। কিন্তু আমার এইভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে। লিখে লিখে। আমি ভাবতাম, দরকারও নাই আসলে আমারে চিনার আমার লিখা পড়ে। হয়ত জীবনানন্দের মতন। ট্রামের নিচে চাপা পড়ে যে বেচারা মারা পড়লো। তার মত জীবন? মন্দ হতো? তার মত দুঃখ নিয়ে শব্দের সাথে বকাবকি, যার সংসারে সুখ নাই ওইভাবে টিকে থাকার মতন? বা আমার সাথে যে গল্প করে এখন। তার জীবন? যে জীবনের কথা শুনলে মনে হয়, ব্যাটা কি করতে বাকি রেখেছে? আর কি করবে? এর শব্দের পর শব্দ পড়ে আমি হাঁ হয়ে বসে বসে ভাবি, ওসব বুঝি আমার কম্মো? এত বৈরাগ্য? এত পাগলামি? এত নিজের মত নিজে হয়ে ওঠার তীব্র আকুতি?
আমার গান গাইতে শখ জাগে। আমি গানের 'গ' -ও জানি না। অথচ গান গাইতে গাইতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর শখ আমার। এটা করিও। খুব আস্তে আস্তে। আমার গলা আমি নিজে শুনতে শুনতে হেঁটে বেড়াইছি গোটা একটা শহর। আমি ভাবতাম, গান শুনাইতে শুনাইতে আগায়ে যাবো। কোন প্রেমিকের কাঁধে প্রেমিকার মাথা দেখলে, পথের দুরন্ত পিচ্ছিদের বিরিং খেলতে দেখে, রিকশাওয়ালারে বসে ভাত খাইতে দেখলে, অভুক্ত শিশুরে মায়ের মাটির চুলায় ভাত রানতে দেখলে আমি বসে বসে গান গাবো। আমার এই ছাড়া কিছুই করার থাকার কথা না। কিন্তু এসব হয় না। আমি এমনি এমনি বাসায় এসে নিজেরে সঁপে দেই। অথচ, আমার এইভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে।
আমার এমনভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে, বহুদিন পর কেউ আমারে পড়ে 'আমি' হইতে চাইবে। আমার ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে আমার গান গাইতে গাইতে কেউ আমার মত স্বপ্ন দেখবে। আমার ইচ্ছে করে আমার কথা চিল্লাইয়া চিল্লাইয়া সবাইরে বলে যাবো, আমি একদিন বাইচা ছিলাম এই দুনিয়ায়। গলা ফাটায়ে গানে, কথায়, লেখায়, আত্মায়, ভাবনায়। একদিন আরও দশজন 'আমি' হইতে চাইবে, আর দশজন আমার মতই কান্না করবে, আমার অনুভূতির কিছু একটা নিজের ভেতর পাবে টের। গান গাবে আর অলস হয়ে শুয়ে শুয়ে ভাববে, যাই শালা বাইর হইয়া। আর বহু বহুদিন পর কেউ এমনভাবে বাঁচতে চাইলে তার মধ্যে আবার ফিরবো আমি। আমি এইভাবে বাঁচতে চাই! বলতেও লজ্জা লাগে, কিন্তু আমি এইভাবেই বাঁচতে চাইছি কিবোর্ড ছেড়ে, আলো আর অন্ধকারের ভেতরে...
আমি কিছুই না।
আমি কিছু হবো বলে মনেও হয় না আসলে।
এইসব ভরপেটে সুন্দর সুন্দর এক একটা কল্পনা। ধরে নেয়া চলে যেন ভরপেটে অনাহারীর কথা ভেবে জল ফেলা সুন্দর একটা গল্প। তার কথা গল্পে বলতে চাওয়ার সুন্দর একটা ইচ্ছে। কাল্পনিক ইচ্ছে। যার কাছে চাঁদ লাগে প্রেমিকা, গল্পের নায়কের চোখে “ঝলসানো রুটি”।
Hi! I am a robot. I just upvoted you! I found similar content that readers might be interested in:
http://www.xinjiejs.com/