নিউইয়র্ক টাইমস–এ ১১ আগস্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এক নিবন্ধে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে নতুন মিত্র খোঁজার হুমকিও দিয়েছেন। এরদোয়ানকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে তুরস্কে আটক হওয়া মার্কিন প্যাস্টর অ্যান্ড্রু ব্রানসনকে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে দিতে বললেও তুরস্ক তাঁকে ছাড়েনি। ব্রানসন ইস্যুসহ বেশ কিছু কারণে গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
এরদোয়ান তাঁর লেখায় বলেছেন, অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্র যদি তুরস্কের বিষয়ে তার অবস্থান না বদলায়, তাহলে তুরস্ক নতুন বন্ধু খুঁজে নিতে বাধ্য হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই এরদোয়ান বলে আসছেন, ইরান থেকে রাশিয়া, চীন থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে তাঁরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সম্প্রসারণ করার কথা ভাবছেন। তিনি ব্রিকস ব্লকে ঢোকার বিষয়েও তাঁর আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছেন।
এরদোয়ান ‘নতুন বন্ধু’ খোঁজার হুমকি দেওয়ার পরপরই ১৩ আগস্ট রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ আঙ্কারা সফর করে তুর্কি দূতদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলুর সঙ্গে তাঁর সিরিয়া নিয়ে আসন্ন সম্মেলন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর ইস্তাম্বুলে তুরস্ক, রাশিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানির সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা। লাভরভের তুরস্ক সফরের মধ্য দিয়ে রাশিয়া ও তুরস্কের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দৃঢ় হওয়ার বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়েছে।
রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালানোর পর রাশিয়ার সঙ্গে তার প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সম্পর্ক খারাপ হয়। ইইউর অবরোধ ২০১৪ সাল থেকে কার্যকর হওয়ার পর থেকে ডলারের বিপরীতে রুবলের দাম অর্ধেক পড়ে গেছে। রুশ বাজেটের স্থায়ী ঘাটতি দেখা দিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণে তুরস্কের মুদ্রা লিরাও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
পশ্চিমাদের সঙ্গে নানা ধরনের সমস্যা থাকলেও দুই দেশের এই গাঁটছড়া বাঁধা এখন পর্যন্ত আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। এখন পর্যন্ত এই দুই দেশের কোনোটিকেই পশ্চিমাদের বিকল্প খোঁজার ব্যাপারে আন্তরিক আগ্রহী মনে হচ্ছে না। এই দুই দেশের নেতারা মুখে যতই পশ্চিমাবিরোধিতা করুন, প্রকৃতপক্ষে তাঁরা প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ও পরে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে আগ্রহী।
আঙ্কারায় লাভরভ ও কাভুসোগলু আলোচনা করার পর যে বিবৃতি দিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছে, দুই দেশের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেড়েছে। পারস্পরিক বাণিজ্য ৪০ শতাংশ বেড়েছে বলেও তাঁরা জানান। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, ২০১৫ সালে সিরিয়ার সীমান্তে তুর্কিরা একটি রুশ বিমান ভূপাতিত করার আগে এই দুই দেশের মধ্যে বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি বাণিজ্য হতো। ২০১৪ সালে তাদের বাণিজ্য হয়েছে তিন হাজার কোটি ডলার। আর ২০১৭ সালে দুই দেশের বাণিজ্য হয়েছে ২ হাজার ১৬০ কোটি ডলার। দুই দেশই প্রতিশ্রুতিশীল বিবৃতি দিয়ে গেলেও ২০১৫ সালের ঘটনার পর দুই দেশ পরস্পরের ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তার কিছুই তারা এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নেয়নি। গত বছর পুতিন ও এরদোয়ানের বৈঠকের পর উভয় দেশ পরস্পরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে একটি চুক্তি হয়। কিন্তু দেখা গেছে, এই চুক্তির পর আঙ্কারা রাশিয়ার আটা–ময়দা আমদানির ওপর আরও দুটি নিষেধাজ্ঞা দেয়। রাশিয়াও তুরস্ককে রুশ বাজারে টমেটো রপ্তানির অনুমতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
জ্বালানি নিয়েও এই দুই দেশের মধ্যে ঝামেলা আছে। রাশিয়া দ্য টার্কস্ট্রিম নামের যে গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, সেটি দিয়ে তুরস্ক রাশিয়াকে ব্ল্যাকমেল করে আসছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে তুরস্কের সীমানায় প্রকল্পটির পরবর্তী ধাপের কাজ শুরু করতে দেওয়ার বদলে আঙ্কারা সিরিয়ায় রুশ–নিয়ন্ত্রিত বিমানঘাঁটি ব্যবহারের সুযোগ চেয়েছে।
গত ১২ জুন এরদোয়ান ও আজারবাইজানের নেতা ইলহাম আলিয়েভ ট্রান্স আনাতোলিয়ান গ্যাস পাইপলাইনের (টানাপ) উদ্বোধন করেন। এই পাইপলাইন দিয়ে আগামী বছর থেকে ইউরোপে বছরে ১ হাজার ৬০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস রপ্তানি করা হবে। এটি রুশ–নিয়ন্ত্রিত টার্কস্ট্রিমের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হবে।
এসব কারণে বোঝা যায়, পশ্চিমাদের বিকল্প মিত্র হিসেবে তুরস্ক যাদের কথা বলছে, তাদের সঙ্গে তার যে খুব সদ্ভাব আছে, তা নয়। গত বছর জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনের সময় এরদোয়ান সংগঠনটিতে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু তুরস্ককে নেওয়ার বিষয়ে এখনো ব্রিকস বা রাশিয়ার কোনো আগ্রহসূচক বক্তব্য আসেনি। ব্রিকসে সদস্য হিসেবে নেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করার মতো কোনো মিত্রদেশও তুরস্কের নেই। তুরস্ক সারা বছরে যেসব পণ্য আমদানি করে, তার অর্ধেকই আসে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে। অন্যদিকে, ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো থেকে তুরস্ক আমদানি করে মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ পণ্য। এসব বাধাবিপত্তির কথা তুরস্ক খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু কথাবার্তায় তারা বোঝাতে চায়, এসব সমস্যাকে তারা সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে।
একই কথা সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে (এসসিও) তুরস্কের যোগ দেওয়ার আগ্রহের বিষয়েও বলা যায়। দুই বছর আগে এরদোয়ান এসসিওতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর আগ্রহ মস্কো ও বেইজিংয়ের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসসিওতে তুরস্ক ঢুকে পড়লে রাশিয়া ও চীনের আধিপত্য হুমকির মুখে পড়বে, এটি তারা বোঝে। বিশেষ করে চীন মনে করে, এই সংগঠনে তুরস্ক ঢুকলে মধ্য এশিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে। ফলে এখানেও তুরস্কের যোগ দেওয়া প্রায় অসম্ভব।
এ অবস্থায় তুরস্ক পশ্চিমাদের যে হুমকি দিচ্ছে, তা আসলে তাদের একটু চাপে রাখার জন্যই। আসলে তুরস্কের পক্ষে পুরোনো অংশীদারদের বাদ দিয়ে সে জায়গায় নতুন কাউকে বসানো প্রায় অসম্ভব। আঙ্কারা চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই উপলব্ধি আসুক, তুরস্ককে হারালে তাদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে এবং সেটি বিবেচনায় নিয়ে ওয়াশিংটনের সমঝোতার দিকে আসা উচিত। তবে আঙ্কারার এই পরিকল্পনা সফল হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।