বোবা ডায়েরী (Untold Notebook) (শেষাংশ)

in #short7 years ago

ভাবলাম মেয়েটির এমন ইমোশনাল মুহূর্তে কোনোরকম ফরমালি ‘স্যরি’ বলে বিদায় হওয়াটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমি স্যরি বলে যে-ই পিছনে হাটা দিবো ঠিক তখোন-ই সে সজোরে পিছন থেকে আমার ডান হাত টান দিয়ে ধরলো! আমি অবাক হয়ে তাকাতেই মনে পড়লো মেয়েটাকে কোথায় দেখেছিলাম, ও, হ্যা, এবারের ভার্সিটির বর্ষবরণ উৎসবে এ মেয়েটাই হারমোনিয়াম নিয়ে স্টেজে কি যেনো একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত ধরলো অমনি বড় ভাইগুলো কি যেনো ব্যাঙ্গ করছিলো আর লজ্জায় সে গান অর্ধেক রেখেই স্টেজ থেকে উঠে পড়ে, আর যদ্দুর জানি মেয়েটার নাম সেঁজুতি, ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে নতুন ভর্তি হয়েছে, তখোন তো তাকে চশমা পড়তে দেখি নি! যাই হোক, আমি বোবার মতো তার দিকে চেয়ে আছি কারন এমনিতেই রমণীর হাতের স্পর্শ এই প্রথম তারউপর আমার এই কার্যকলাপ আমার বন্ধুরা দেখে নিশ্চয়ই হেসে খুন, সে আলতো কন্ঠে কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে, “আমার চশমা ছাড়া আমি চোখে একদম দেখতে পাই না, আর আপনি সেখানে আমার পিকনিক বরবাদ করে কোথায় যাচ্ছেন?” আমি আমতা আমতা করে বললাম, “দেখুন, আমি তো চশমার মেকানিক নই যে আপনার চশমার গ্লাস ঠিক করে দিবো...” কথা শেষ করবার আগেই মেয়ে বলে উঠলো, “ইচ্ছে ছিলো মেঘগুলোকে নিজের সামনে থেকে দেখবো, সব আপনার দোষ”। বলে সে চুপ করে হাত ধরে রইলো। আমার এখন অবশ্য মেয়েটার জন্যে সহানুভূতি কাজ করা শুরু করলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম দোষের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্যে কি করতে পারি, প্রতোত্ত্যরে সে বলে উঠলো, “আপনি যেখানে যেখানে যাবেন, আমিও সেখানে সেখানে যাবো! এ ছাড়া অন্য কিছুতেই এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না। মানে আমাকে একা ফেলে কোথাও যেতে পারবেন না!” বলেই সে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল!
যাহ শালার, যেদিন অই পিকু-টার(পোষা বিড়াল) ক্যাঁচক্যাঁচানিতে ঘুম ভাঙ্গে সেদিন-ই চারপাশে শনি ঘুরতে থাকে, আর আজকের শনি বেশ বড়ো সেটা ধাক্কার খাওয়ার পর পর-ই আঁচ করেছিলাম। অগত্যা মেয়েটার সাথেই তার ডিপার্টমেন্টের বাসে উঠা লাগলো। বাসে উঠার পর সবাই আমাদের দিকে হা’ হয়ে তাকিয়ে আছে, যেনো একজন অন্ধ ফকিরের ভিক্ষা খুজতে আরেকজন তাকে সাহায্য করছে! আমি চুপচাপ বাসে বসে রইলাম, সবাই হৈ-হুল্লোড় করছে মাঝখানে আমি একা স্রষ্টার নাম যপছি কখোন এই মেয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবো। আর বাসে মেয়ের বন্ধুরা কানের পাশে এসে জিজ্ঞাসা করছে ‘হ্যাব্লাটা কে’ মেয়ে ততোবার-ই উত্তর দিচ্ছে ‘আমার ছোটভাই’! বাস কতোক্ষন চলেছে টের পেলাম না ঘুমের ঘোরে, সে যখন হাত ধরে টানছে তখন বুঝতে পারলাম বাসের যাত্রা শেষ হয়েছে, বাস থেকে নেমে দেখি সবুজ যেনো কবেকার মৃত পাহাড়্গুলোকে জীবিত করে রেখেছে। এবার ঝামেলা আরো চরমে, আমি একদিকে যাবো তো উনি যাবেন অন্যদিকে, আমি পাহাড়ে চড়তে গেলে উনিও চড়বেন আমার সাথে, আমি ক্লান্ত হয়ে গেলে উনার পায়ের তেজ বেড়ে যায় দ্বিগুণে। এরকম কতো হাজার দোষের প্রায়শ্চিত্ত আমাকে দিতে শুধু আল্লাহ মালুম। হঠাৎ আকাশ মুখ কালো করে পুরো পাহাড়ের শহরজুড়ে নামালো ঝুম বৃষ্টি। সবাই যে যার মতো যেখানে পারছে আশ্রয় নিচ্ছে, আমি তাকে নিয়ে এক দৌড়ে একটা ছোট্টো চায়ের দোকানে নিয়ে আসলাম। অন্তত এখানে মেয়েটা আমাকে বিশ্রাম নিতে দিবে। চায়ের অর্ডার দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে আনমনে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, “কি দেখছো?” একটা দুষ্টুমি হাসি ঠোটে ঝুলিয়ে বলল “ব্যাগটা ধরো”। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে চায়ের কাপ ফেরত দিতে দিতে দেখি সে এই অঝোর বৃষ্টিতে হাত পা ছড়িয়ে ভিজছে। এতো দেখছি হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় ‘রুপা’, যদিও নীল রঙের শাড়ি পড়া নেই! যতোই এই মেয়ের কান্ড-কারখানা দেখছি ততোই অবাক হচ্ছি। মেয়েটার চশমা ভাঙ্গার সাথে সাথে বোধ হয় মাথার দু’ একটা নাটও খুলে পড়ে গিয়েছে! যেখানে একটা নেড়ী কুকুর পর্যন্ত বৃষ্টির ভয়ে বাসের তলে গিয়ে লুকিয়ে আছে সেখানে উনি উন্মাদনৃত্য করছেন বৃষ্টিতে! আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখোন যে ঘুমের ঘোরে চলে গিয়েছি ঠিক বলতে পারবো না। ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমি ওই দোকানের বেঞ্চিতে কখোন যেনো শুয়ে পড়েছিলাম, আর সে আমার মুখের উপর ঝুকে আছে। তার ভেজা চুল থেকে টিপ টিপ করে পানি গালের উপর পড়ছে। আমার রাগ এবার তার উপর চূড়ান্ততে গিয়ে পৌছেছে। আমি হুড়মুড় করে বলে উঠলাম, “আর কীভাবে আমার দোষের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি, চুলগুলো মুছে দিয়ে? আমাকে মাফ করো, আর তোমার অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না!”- বলেই থমকে গেলাম, এভাবে ডিরেক্ট বলা বোধ হয় উচিত হয় নি! সে এবার শান্তসুরে বলল, “দেখো, ওই ভাঙ্গা চশমাটার পাওয়ার নেই বললেই চলে, তোমাকে গ্লাস ভাঙ্গার দোষ দেখিয়ে আমার পাশে রেখেছি একমাত্র কারন হলো ভার্সিটিতে আমার কোনো ভালো বন্ধু নেই, তাই ভাবলাম তোমাকে নিয়ে পুরো পিকনিকটা ইঞ্জয় করবো! তোমার চলে যেতে ইচ্ছে হলে আমি আর বাঁধা দেবো না।” আমি তার কথা শুনে থ বনে গেলাম, কি বোকাই না আমি! অতঃপর পুরোটা সময় তার সাথে কোনো বলিনি রাগে আর অভিমানে, সেও বলে নি।
বাসায় আসার পর থেকে ওই মেয়ের ভূত মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না কোনো ভাবেই, বুকশেলফ-টা পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আম্মু বোধ হয় কিছু একটা বুঝতে পারছে, আর পিকুটাও কেমন যেনো করছে বাসায় আসার পর থেকে। বার বার আমার টুরিস্ট ব্যাগটার কাছে গিয়ে ফিরে আসছে। পিকনিক থেকে ফেরার পর ব্যাগটা কোনোরকম বিছানার কোণায় ফেলে রেখেছিলাম। পিকুর এরকম আচরন দেখে ব্যাগের চেইন খুলে দিলাম, ভাবলাম বোধ হয় এর ভিতর কোনো খাবার আছে। লক্ষ্য করলাম পিকু মুখ দিয়ে হাতড়িয়ে কি একটা বের করে আমার সামনে রেখে দৌড়ে পালালো, দেখলাম সেটা আর কিছু না। সেঁজুতির একটা হেয়ার ব্যান্ড ভুলে আমার ব্যাগে ভরে রেখেছিলাম, সেটা দিতে ভুলে গিয়েছি। হাতে নিয়ে দেখলাম কয়েকটা চুল লেগে আছে সেটাতে। মুহূর্তের মধ্যেই তার হাসি, পাগলামি, শেষ কথাগুলো মনে পড়তেই বুকে একটা ব্যাথা অনুভব হওয়া শুরু করলো! আমি স্থির হয়ে রইলাম। এটাই কি তবে ভালোবাসা যেটা এতোদিন নাক ছিটকিয়ে পাশ কেটে চলেছি? সারারাত ঘুমাতে পারলাম না, বারবার সে চোখের সামনে ভাসছে, একবার আমার হাত ধরে টান দিচ্ছে, একবার বৃষ্টিতে হাত পা ছুড়ে লাফাচ্ছে, গান গাচ্ছে, আরো অনেক কিছু। সেদিন রাতেই মনে মনে একটা চূড়ান্ত ডিসিশান নিয়ে ফেললাম।
পরদিন ভোর হতেই তার দোতলা বিল্ডিঙের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সাথে পিকুও আছে সাহস যোগানোর জন্যে। ঠিক কতোক্ষন পর যেনো দেখলাম সে তার বারান্দায় ভেজা চুল মুছতে মুছতে গাছে পানি দিচ্ছে। হঠাৎ নিচে চোখ পড়তেই আমাকে দেখে কি যেনো একটা ভাবল। তারপর হাতের পাঁচ আঙ্গুল ইশারায় আমার দিকে দেখিয়ে ভিতরে চলে গেলো। বুকের বামপাশটায় হাত দিয়ে দেখি কে যেনো এসে হাতুড়ি দিয়ে পেটাপেটি করছে। একটু পর সে চুল বাঁধতে বাঁধতে আমার সামনে দাঁড়ালো। স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো, কেনো এসেছো? আমি জবাব না দিয়ে পকেট থেকে হেয়ারব্যান্ড বের করে তার হাতে দিলাম। সে হাতে নিতে নিতে মুচকি হেসে বলল, “কিছু বলবে না আমি চলে যাবো।” আমার তোতলামী রোগ শুরু হয়ে গেলো, “ইয়ে, মানে, আমি গত রাতে ঘুমাই নি, ভাবছি একটা কথা তোমাকে বলা দরকার”, সে যতোই আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছে আমি ততোই চোখ লুকিয়ে নিচ্ছি, আজকে কালো চশমা পড়ে আসা উচিত ছিল। সে আবার জোর দিয়ে বলল, “বলো, কি বলবে?” আমি এদিক অদিক পিকু-কে খুজছি, শালাটা গেলো কোথায়, অকাজে গুরু আর কাজের বেলায় ঠন ঠন! সে নিজের থেকেই বলে উঠলো, “আমাকে ভালো লাগে বা আমাকে ভালোবাসো, এটাই তো?” যাক বাবা, মনে অন্তত স্বস্তি এলো যে সে বুঝতে পেরেছে, আমি হাল্কা হাল্কা মুখ নিচু করে মাথা নাড়াতে লাগলাম। অমনি সে বলে উঠলো, “ভালোবাসা এতো সহজ না খোকা, বুঝলে, আমি যদি বলি ওই সাত তলা ছাদ থেকে লাফ দিতে, পারবে?” আমি তার কথা শুনে থতমত খেয়ে চুপ করে রইলাম। সে আবার জোড় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “পারবে?” আমি এবার মুখ দিয়ে উচ্চারন করলাম, “নাহ”। সে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লো। আমি আর কোনো কথা না বলে আমি হাঁটা শুরু করলাম রাস্তার দিকে আর ভাবতে লাগলাম ভালোবাসার সাথে ওই রঙওঠা বিল্ডিঙের ছাঁদ থেকে লাফ দেয়ার কি সম্পর্ক! আশা ছিলো সে পিছন থেকে ডাকবে, সেটাও হলো না। তাহলে কি এই জগত সংসারে সব-ই মিথ্যা? এরকম ভাবতে ভাবতে কখোন যে রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছি খেয়াল নেই, একটা বিশাল হাইওয়ে বাসের বিশাল হর্নে চকিত ফিরলাম কিন্তু কোনদিকে যাবো স্থির করতে করতে পিছন থেকে একটা ধাক্কা আমাকে কয়েক হাত দূরে ফেলে দিলো। বাস সেখানেই ব্রেক কষে ফেলল, তারপরও কয়েকজনের আত্মচিৎকার শুনতে পেলাম। চশমাটা কোথায় গিয়ে পড়েছে কে জানে, আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে পরখ করলাম একটা মেয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আমি আলতো করে শরীরটা আমার কোলে তুলে নিলাম, শরীরটাও আমার দু হাতের ভিতর নিরব ঠাই পড়ে রয়েছে! চুল থেকে আজ রক্ত ঝড়ছে, সেদিনের মতো বৃষ্টির পানি নয়, তবুও তা অন্ধচোখে রক্তগুলো মুখে মাখিয়ে নিলাম নিজ হাতে। মুহূর্তের সবে শেষ, বুঝলাম সেঁজুতি আজ আমাকে ভালোবেসেছে আর শিখিয়ে গিয়েছে!
(সমাপ্তি)