নিজামউদ্দিন হাসিমুখে ‘অশ্বমানব’কে দেখছেন। তার জন্য ‘হাসিমুখ’ না বলে ‘স্বাভাবিক মুখ’ বলা যেতে পারে! কারণ তার মুখের গড়নই এমন। যেকোনো সময় তার দিকে তাকালে মনে হয় মানুষটা ‘হাসিখুশি’ ভঙ্গিতে আছেন। কোনো দুর্ঘটনার খবর বা মৃত্যুসংবাদ কেউ তাকে দিতে এলে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বার্তাবাহক চরম আফসোসের সুরে কথাগুলো বললেও নিজামউদ্দিনের হাসিমুখ যেন বলে ওঠে ‘প্রেজেন্ট স্যার’! তখন ব্যাপারটি হয়ে ওঠে দ্বিগুণ হাস্যকর।
‘অশ্বমানব’ নামটি তারই দেওয়া। এক যুবক সকাল থেকে তার বাড়ির সামনে কড়া রোদে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটির হাতে ফুল আর গিফটের প্যাকেট। দূর থেকে মনে হচ্ছে, দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। আগেও বেশ কয়েকদিন এই কাজটি সে যত্নের সঙ্গে করেছে। ফিটফাট ফুলবাবু সেজে ফুল-গিফট হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঘুম; এই ঘুমের কাজটি ঘোড়া দাঁড়িয়েই সারে! তাই নিজামউদ্দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির নাম রেখে দিয়েছেন ‘অশ্বমানব’।
নিজাম সাহেব দোতলার বারান্দায় বসে আছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে তিনি এভাবেই বসে থাকেন। এজন্য নিজেরও একটি নাম দিয়েছেন; ‘গুল্মমানব’। তিনি নিজেকে লতা-গুল্মের মতোই অতি সাধারণ মনে করেন। তাছাড়া গুল্ম যেমন চলৎশক্তিহীন জীব, তেমনি তিনিও সারাদিন খুব একটা হাঁটাচলা করেন না। বাসায় কেউ না এলে তিনি এখানে বসেই বই পড়েন, পেপার পড়েন, কিছুক্ষণ পরপর চা খান। আগে ‘গ্রিন টি’ ছিল তার ফেবারিট। ইদানীং ‘মিন্ট টি’ পান করেন।
‘গুল্মমানব’ মাঝেমাঝে চোখ বন্ধ করে পরিচিত-আধাপরিচিত মানুষের; এমনকি নিজের জীবন নিয়ে ভাবেন। বাড়ির সামনের রাস্তাটিতে যাওয়া-আসা করা লোকজনের কর্মকাণ্ড দেখেন। সঙ্গে থাকে খাতা-কলম। হঠাৎ-হঠাৎ খাতায় কীসব টুকেও রাখেন! সেগুলো নিয়ে রাতে আবার বসেন।
ছেলেটি দাঁড়িয়েই আছে। ঝাঁ-ঝাঁ রোদ পড়েছে। নিজামউদ্দিন দু’বার ডাক দিলেন ‘অশ্বমানব’ বলে। কেউ তাকাল না। এই নাম শুনে ছেলেটির তাকানোর কোনো কারণও নেই। তাছাড়া এখান থেকে আসল নাম ধরে ডাকলেও তার শুনতে পারার কথা নয়। নিজাম সাহেব বসে আছেন রাস্তার পাশের একটি বিল্ডিংয়ের দোতলার বারান্দায়। আর ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপারে একটি খোলা জায়গায়। রাজনকে দিয়ে ছেলেটিকে ঘরে ডেকে আনা যেতে পারে। কিন্তু এ মুহূর্তে তার সেই ইচ্ছা করছে না।
বারান্দা থেকে নিজামউদ্দিন ‘নসিমনের দুধ চায়ের দোকান’ দেখতে পান। সবসময় কাস্টমার গমগম করে। এই ঠা-ঠা রোদেও মানুষ চা খাওয়ার জন্য দোকানে গিজগিজ করছে। তিনি এই দোকানের ওপর বিরক্ত। নসিমন তার দুগ্ধপোষ্য বাচ্চাটিকে বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে চা বানায়। মাঝেমাঝে বাচ্চা মুখ সরিয়ে নেয়। নগ্নবক্ষ নসিমন একমনে চা বানিয়ে যায়; আশেপাশের এত মানুষের কথা তার খেয়াল থাকে না! পাখির চোখে দেখায় (বার্ড’স আই ভিউ) মনে হবে, কাস্টমাররা কেউই সেদিকে তাকান না। কিন্তু একজন কাস্টমারও বক্ষদর্শণ না করে সেখান থেকে ওঠেন না। নিজামউদ্দিন কাস্টমারদের তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। একেকজনের ভাবভঙ্গি, তাকানোর কৌশল, হাসিমুখ- এসব দেখে দূর থেকেই তিনি তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, জীবনাচরণ সম্পর্কে ধারণা করতে চেষ্টা করেন।
‘অশ্বমানব’ বিশেষ কারও জন্য অপেক্ষা করছে। অবশ্য নিজাম সাহেব যে কদিন ছেলেটিকে দেখেছেন, সেই কদিন কেউ-ই ছেলেটির কাছে আসেনি। তিনি সাগ্রহে বসে আছেন, আজ হয়তো কেউ আসবে। নিজাম সাহেবের এই ‘অশ্বমানবের’ নাম নিশান। নিশান একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ-এমবিএ করেছে। এখনো বেকার। দেশের চাকরি বাজারের অবস্থা বুড়িগঙ্গার পানির মতোই জঘন্য। আসলে শুধু জব মার্কেট না, সব মার্কেটের অবস্থাই এক। এমনকি দেশে রাস্তার অবস্থা, মানুষের লাঞ্চ-ডিনার-নাস্তার অবস্থা, জনগণের মাঝে আস্থার অবস্থাও এক।
আজ নিশানের জীবনের একটি বিশেষ দিন। একুশে অক্টোবর। প্রিয় মানুষের সঙ্গে তার প্রথম ঘোরাঘুরির দিন। মেয়েটির নাম রেখা। নিশানের ক্লাসমেট। পাশ করেই একটি ব্যাংকে চাকরি শুরু করে। এখানেই ছিল সেই ব্যাংকের অফিস। মাস দুয়েক আগে ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি! বিল্ডিংটি ধসে পড়ে। প্রায় সব লাশই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল; তবে রেখার লাশ পাওয়া যায়নি। এখানেই তার ভালোবাসার মানুষ ঘুমিয়ে আছে। ঠিক কোন অংশের মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে, তা জানতে পারলে নিশান সেখানটায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিত।
নিশানের বন্ধুরা প্রায়ই তাকে খ্যাপাতো। তার কণ্ঠ নাকি স্রষ্টাপ্রদত্ত, একেবারে গানের অযোগ্য! সে রেখাকে তার সুরহীন কড়কড়ে কণ্ঠেই গেয়ে শোনাত,
‘তুমি চাইয়া দেখ আমার কাছে কী দেই তোমায়,
ফুল চাইলে ঘুম পাড়াবো ফুলের বিছানায়।
নদী চাইলে সাগর দেব চাও যদি তারা,
পুরো আকাশ ঢাইলা দেব ভালোবাসায় ভরা।’
প্রাণের প্রিয় মানুষটি কখনো কিছু চায়নি; আর চাইবেও না। কে জানে, নিশান বারবার ছুটে আসুক, হয়তো এটুকুই সে চায়। একারণেই বুঝি নিশান এখানে বারবার ছুটে আসে!
একসময় সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। দুপুর হামাগুড়ি দিলো বিকেলের দিকে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, নিশানের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। প্রকৃতি পানি শুকানোর প্রক্রিয়া না রাখলে মানুষের চোখের পানিতে আরেকটি মহাসাগরের সৃষ্টি হতো। নাম হতো ‘দ্য টিয়ার ওশান’।
Congratulations @cemec10! You have completed some achievement on Steemit and have been rewarded with new badge(s) :
Award for the number of upvotes received
Click on any badge to view your own Board of Honor on SteemitBoard.
To support your work, I also upvoted your post!
For more information about SteemitBoard, click here
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP