বাস থেকে নেমে বেশ হচকচিয়ে গেলাম। এখানে-সেখানে মাইকিং, "পকেটমার হতে সাবধান", কোথাও "৩০০ টাকার এনার্জি বালব" ইত্যাদি! সামনে মাথা উচিয়ে দেখলাম বাবা বেশ হন্ত-দন্ত হয়ে হাটা শুরু করেছেন। উনার মাথার উপর যে ২০কেজি চালের বস্তা তাতে যেনো উনার কোনো মাথাব্যথাই নেই। আমার দুই হাতেই কাপড়ের ব্যাগ! দড়ি যেকোনো সময় ছিড়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। তখন পিছন থেকে বাবাকে ডাকবো কিভাবে বুঝতে পারছি না।
ঢাকায় এটাই যে আমার আসা, তা কিন্তু না। ক্লাস টু'তে একবার মা'সহ এসেছিলাম যদিও তখন এসব মাইকিং আর লোকজনের বিকিকিনি দেখি নি। তবে মা'সহ সেদিন যেই গন্তব্যে গিয়েছিলাম আজো সেই গন্তব্যেই যাচ্ছি। পার্থক্য আজ শুধু মা পাশে নেই।
বড় মামার বাড়ির নাম 'বনলতা' যদিও বাড়ির ভিতর 'বন' বা 'লতা'র কোনো বালাই নেই। বড়লোকদের বাড়ির নামগুলি বোধ হয় একটু সাহিত্য ঘরানার না হলে চলে না। বাড়িটি বাইরে থেকে একটু পুরাতন ঘরানার মনে হলেও ঘরের ভিতর শ্বেত পাথরের মারবেল বেশ ছিমছাম করে বিছানো।
ভাবলেশহীন মুখে মামা ড্রয়িংরুমের একটা ইজি চেয়ারে বসে আছেন। হাতে কোন একটা ইংলিশ ম্যাগাজিন। আমি বসে আছি মামার ঠিক সামনের সোফায়। আমার মুখ সরাসরি আমার গুটিসুটি মারা পায়ের দিকে। মনে হচ্ছে পায়ের নিচের শ্বেত পাথরের সাথে আমার পা জোড়া বড্ড বেমানান। যদিও একটু আগে পা ভালো করে ধুয়েই সোফায় বসেছি। আর বাবা বসেছেন মামার ঠিক ডান পাশে, মুখে প্রশস্ত হাসি। মুখ সামনে টেনে এনে মামার দিকে তাকিয়ে মামার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন বোধ করি। মামা ম্যাগাজিন থেকে চোখ না তুলেই জিজ্ঞাসা করলেন, "কী হেতু সন্ধিস্থাপন?"
মামার অহেতুক এরকম সময়ে গম্ভীর গলা শুনে মনে হলো যেনো পুরো রাজ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে, হাজারো ঢোল পেটানো হচ্ছে, রাজার থেকে অনুমতি পেলেই সেনাপতি সিংগায় ফু' দিয়ে বলবেন "আক্রমণ!"
আমার পা' জোড়া আরো গুটিসুটি মেরে গেলো। কিন্তু বাবাকে দেখলাম উনার হাসি আরো বিস্তার পেয়েছে মামার কথা শুনে, "কী যে বলেন ভাইসাব? আপনারা হইলেন বটবৃক্ষ, আর আমরা হইলাম ছোটোখাটো কাক মানে গেরামের 'কাউয়া'!"- বলেই আমার দিকে তাকালেন। এসময় বাবার মতো আমিও দাত বের করে একটা হাসি দিবো কিনা বুঝতে পারছি না। মামা আবার হুংকার ছাড়লেন, "I don't Care, যা বলবেন সোজা বাংলায়!"- বলেই বাবার সামনে দিয়াশলাই আর সিগ্রেট বের করে ফুস করে সিগারেট ধরালেন। বাবা এখনো হাসি দিয়ে দাত বের করে আছেন, যেনো মামার সিগারেট ধরানোটা বেশ উপভোগ্য। এদিকে হাজার দামামা বেজেই চলছে আমার মনে। বাবা তার প্রশস্ত হাসি নিয়ে বললেন, "ছেলের ভিতরে খুব টেলেন্ট, যদি একটু দেখতেন আপনারা!" মামার সংক্ষেপ উত্তর, "সমস্যা নাই!"
বাবার হাসি আরো দীর্ঘ হলো। মনে হচ্ছে সন্ধিস্থাপিত হয়ে গিয়েছে। এদিকে সেনাপতি যুদ্ধের অনুমতিপত্র না পেয়ে ম্লান মুখে প্রাসাদে ফিরে এলেন। আমিও ফিরে এলাম আমার আর বাবার জন্যে নির্ধারিত একটা স্টোর-রুমে। শুনেছিলাম বড়লোকদের স্টোর-রুম নাকি থাকে পুরাতন আসবাব পত্রে ঠাসা। কিন্তু মামাদের স্টোর-রুমে দেখি সুন্দর করে বিছানা পাতা। পুরাতন জিনিষ বলতে বিছানার পাশে একটা নষ্ট টেলিফোন!
সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু করছে। বিছানার পাশের থাই খুলে দিলাম, বিকেলের সূর্য ভেদ করে বাইরে গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মনটা কেমন যেনো পংকজ উদাসের মতো উদাস হয়ে গুন-গুন করতে ইচ্ছে হচ্ছে! হঠাত চোখ আটকে গেলো জানালার সামনে একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির ছাদে। একটা মেয়ে খোলা চুলে দু' হাত ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে যদিও একটা হাতে চায়ের মগ ধরে আছে বলে মনে হচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, মেয়েটা কিছুসময় এক হাতে চোখের সামনের অবাধ্য চুলগুলোকে পিছনে নিচ্ছে, আবার কিছুসময় মগের উপর হাত আগলে ধরছে বৃষ্টি থেকে গরম চা'টাকে উদ্ধার করার জন্যে। দৃশ্যটা যতটাই অদ্ভুত ততোটাই সুন্দর মনে হলো। আমার মনের ভিতর কে যেনো বেদনার 'হু হু' শব্দ করে চলে গেলো! কী আজব, এমন অনুভূতি তো কখনো হয় নি এর আগে? কিছু দৃশ্য এতো সুন্দর হয় কেনো?
ইচ্ছে হচ্ছে সাদা ক্যানভাসে সাত রঙ ছুড়ে দিয়ে পাবলো পিকাসোর মতো বালিকার খোলাচুলে এরুপ বৃষ্টিবিলাস আজীবন স্মৃতির পাজড়ে বন্দী করে রাখি!
(চলবে)
nic
thank u sister
Congratulations @habib.cse! You received a personal award!
Click here to view your Board
Do not miss the last post from @steemitboard:
Vote for @Steemitboard as a witness and get one more award and increased upvotes!
Congratulations @habib.cse! You received a personal award!
You can view your badges on your Steem Board and compare to others on the Steem Ranking
Do not miss the last post from @steemitboard:
Vote for @Steemitboard as a witness to get one more award and increased upvotes!