মানুষ যে সৃষ্টির সেরা জীব তার কারণ হচ্ছে মানুষের বিভিন্ন রকম অনুভূতি আছে এবং সেই অনুযায়ী অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে সে। মানুষের যে অনন্য অনুভূতি গুলো রয়েছে তার মধ্যে রাগ বা ক্ষোভ একটি। রাগ যেমন একজনকে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ করতে পারে, তেমনি ভুল সিদ্ধান্ত নিতেও প্ররোচিত করতে পারে। সে রাগের মাথায় মানুষ এমন অনেক কিছুই করে যার জন্যে পরে গিয়ে কষ্ট পায়৷ যেমন - একজনকে দেখলাম স্ক্রিন ফাটা মোবাইল ফোন নিয়ে সার্ভিসিংয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে।
-কিভাবে ভাঙলো ভাই?
-রাগ করে আছাড় মারসি৷
-নিজেই তো ভাঙ্গলেন, এখন ঠিক করার দরকার কি!
-ভাই রাগের মাথায় হুশ ছিল না, এখন জরিমানা দিয়ে তার খেশারত দিব।
এই জরিমানাটা দিয়ে হলেও মানুষ ভেতরের ক্রোধ, জ্বালা জুড়াতে চায়। কেউ যখন মোবাইল ভাঙ্গতে চায়, আপনি গিয়ে বলেন, ভাই প্লিজ মোবাইলটা ভাঙ্গবেন না, আমাকে দিয়ে দেন, আমি চালাই- সে কি দিবে ফোনটা? মোবাইলটা সে ভাঙ্গবে ঠিকই কিন্তু দিবে না। নিয়মে নেই। কারণ, ব্যাপারটা অস্তিত্বের জানান দেয়া, নিজের ক্ষোভের জানান দেয়ার সাথে সম্পর্কিত৷
রাগ, ক্ষোভ, অভিমান খুবই জটিল জিনিস। অনেকেই অভিমানে মরে টরে পর্যন্ত যায়৷ একজন কথায় কথায় বললো, তার এখন বাঁচতে ইচ্ছে হয় না। আত্মহত্যা করবে। আমি ভাবলাম, মরুক, কত লোকে মরে। এই শালা মরেই তো যাবে। তারে নিয়ে একটু এক্সপিরিমেন্ট করি।
বললাম, আত্মহত্যা কেন করতে চাও?
-কিছুই ভাল লাগছে না৷
-ঠিক আছে, মারা যাও। সবারই মরতে হবে। তুমি নাহয় আগেই মরলা। কিন্তু আমাকে একটা উপহার দিয়ে যাও।
-কি দিতে হবে বলেন ভাই৷
আমি বললাম, তোমার একটা হাত আমি কেটে নিব, তারপর কাটা চামচ দিয়ে একটা চোখ উপড়ে ফেলব৷
-ভাই আপনি কি পাগল?
-হ্যা। আমরা সবাই পাগল৷ নকশা করবা না। মরেই তো যাবা। মরে গেলে দুইটা চোখই তো পোকামাকড় খাবে। আমি একটা তুইলা নিব, সমস্যা কি?
-আপনি চোখ নিয়া কি করবেন?
-মার্বেল খেলব৷
-ভাই, আপনি আমার সাথে মজা করেন? আপনার সাথে কথা বলে আমার হতাশা আরো বেড়ে গেল।
-মজা তুমি করতেসো। তুমি, হতাশ, মরবা, পৃথিবীকে বুঝাবা তুমি কি ছিলা! আমি তোমাকে সেটা বেঁচে থাকতেই দেখাই। একটা হাত কেটে দেই। আচ্ছা আঙ্গুল দিয়ে শুরু করি। একটা আঙ্গুল কাটি। দেখো, কেমন লাগে? একটা চোখ তুলে নেই। দেখো, দুনিয়ায় ডিপ্রেশন কই যায়!
-ভাই, ব্যাপারটা মানসিক। আপনি বুঝেন না কেন?
-মানসিক হলে মানসিকভাবে সামাল দেও। শারীরিক ভাবে মরতে চাও কেন?
-কষ্ট যে সহ্য হয় না৷ প্রেমিকা আমার কষ্ট বোঝে না।
-তোমার কষ্ট বোঝাব তাকে। দেও তোমার কান কেটে প্রেমিকার কাছে পাঠাই।
-ভাই, আপনি এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার কবে থেকে শুরু করলেন?
-আজকে থেকে। মরতে চাও মরো, শুধু আগে একটা হাত কেটে দেই তোমার।
ছুরি বের করে হাতে একটা পোচ দিলাম। ভোতা ছুরির মার। দিয়েই দৌড়। সেই ছেলে দুইদিন হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে ঘুরে আমাকে খুঁজে। সামান্য হাত একটু কেটে যাওয়াতেই ব্যাথা কমানোর জন্য কত তোলপাড়। আর কি অবলীলায় মানুষ মরে যাইতে চায়!
খেয়াল করলে দেখা যাবে, ছোট বাচ্চারা যখন নিজে নিজে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পায়, তখন কাঁদে না। কিন্তু, আপনি সামান্য ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিলে সে এমন প্রচন্ড কেঁদে অস্থির হয়ে যায় যে, আপনার নিজেরই অপরাধবোধ শুরু হয়ে যাবে। কারণ, নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সে জানান দিতে চায়। যারা মরতে চায় বিভিন্ন রকম অভিমানে তাদের মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে। তারা চায় কেউ একজন অপরাধবোধে ভুগবে, তাকে কষ্ট দেয়ার পরিণামে মানসিক যন্ত্রণা বোধ করবে।
মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মধ্যেও আমি দেখেছি সহায় সম্পত্তি বন্টনের চিন্তা। রেখে যাওয়া সম্পত্তি সে ভোগ করতে পারুক না পারুক, এগুলো তার নিজের, এই বোধটা তার থাকে। সাড়ে তিন হাত মাটি যদি ঠিকানা হয়, তাহলে হাজার বিঘার জমির কি দরকার! কিন্তু মানসিক হিসাবে ব্যাপারগুলো জটিল। মানুষ নিজের অস্তিত্ব ছড়িয়ে রাখতে চায় সব জায়গায়। তার একটা মানসিক নির্ভরতা আছে, এসবের মধ্যেই তার টিকে থাকা।
কেউ আপনার ভালবাসা প্রত্যাখ্যান করেছে বলে আপনি আত্মহত্যা করছেন না, অতটা প্রেমিক কেউ হয়নি এখনো। আপনার অস্তিত্বটা কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না, এই আঘাতটা আপনাকে কষ্ট দেয়। নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হয়। একারণেই এইসব মুহুর্তে লোকে যতই আপনাকে বুঝাক, আপনার চেয়েও অনেকে বাজে অবস্থায় বেঁচে আছে, আপনি তাতে কনভিন্সড হন না। কারণ, আপনার কাছে নিজের অস্তিত্বটাই মূল কথা।
চাকরি নেই বলে বাবা মাকে সন্তুষ্ট করতে না পেরে কেউ মরে না৷ অতটা ভক্তি থাকলে লাখ টাকার চাকরিজীবিরা গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে বাবা মাকে রেখে আসত না। আপনার অযোগ্যতাকে যখন আপনি জয় না করে স্বীকার করে নেন, ওই মুহুর্তে আপনার নিজের কাছেই আপনার অস্তিত্ব ঠুনকো হয়ে যায়। হীনমন্যতা তৈরি হয়।
আমরা প্রবলভাবে জানান দিতে চাই, আমি আছি। আমার অস্তিত্ব আছে। সেটা বোঝানোর সবচেয়ে বাজে উপায় হিসেবে বেছে নেই, আত্মহত্যাকে। আপনার অনেক কিছু থাকতে পারে, অনেক অর্জন। কিন্তু তারপরেও কিছু প্রমাণের দায় থাকে। হাজার লোকে আপনাকে ভালবাসলেও, বিশেষ কেউ আপনাকে একদমই স্বীকার করতে চায় না। আপনি চান, সবাই আপনাকে বুঝবে, মূল্য দিবে। গুরুত্ব দেবে।
কিন্তু, যার/যাদের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা তাদের কাছে আপনি গুরুত্বহীন। ফলে নিজের বাকি সব কিছু দিয়েও যখন আপনি তাদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে পারছেন না, তখন আপনার মনে হয়, জীবনের মানে কি তবে! অস্তিত্বের এই অবহেলা আপনাকে ভাবায় মৃত্যু হোক সমাধান। যারা এভাবে ভেবে ফেলে, তারা খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। এদেরকে বোঝানো কঠিন। আমরা বলি, মরার পর সবার দরদ উথলে উঠে। কেউ মরার পর কেন কথা বলি?
কারণ, একটা মানুষ ছিল, সে নেই। তার এই শুণ্যতা স্বাভাবিকভাবে বোঝা না গেলেও, মৃত্যুতে সাময়িক বোধটা হয়। আরেহ, এই মানুষটা আর নেই কোথাও! কারো মৃত্যুতে ক্ষতি হয়েছে বলে এমন ভাবি না আমরা, স্বাভাবিক একটা শূণ্যস্থানের উপলব্ধি থেকেই ভাবনাগুলো আসে। একটা শতবর্ষী গাছ কেটে ফেললেও তো জায়গাটা খালি খালি লাগে, অচেনা লাগে। ঘরের আসবাবগুলোও একটু অদল বদল করে দিলেও তো চেনা জগতটায় কিছু একটা পাল্টেছে বলে কেমন কেমন লাগে। এটা সাময়িক অনুভূতি। অভ্যস্থতায় আবার ঠিক হয়ে যায় সব।
তাই, কেউ যদি ভাবে সে চলে গেলে তার অস্তিত্ব নিয়ে ঝড় উঠবে (মুখে অবশ্য সবাই বলে, আমি না থাকলে কারো কিছু এসে যাবে না, মনে মনে আশা করে, কেউ বুঝবে) এটা একদম ভুল ধারণা। দুনিয়ায় প্রতিদিন দেড়লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। তাতে কি আটকে যাচ্ছে এমন! কিছুই না। আমাদের সবারই প্রিয়জন হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিবছরই। যে মানুষটার সাথে প্রাণের সম্পর্ক, সে গেলে বেদনা লাগবেই। তবে কতদিন। একসময় মানুষ প্রিয় মানুষের মৃত্যুর তারিখটাও ভুলে যায়। শোক পুরানো হয়, সুখ পুরানো হয়। আমরা মানুষ৷ আমাদের সবসময়ই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই৷ তাই, যার অস্তিত্ব নেই, তাকে আঁকড়ে খুব বেশি বর্ষ আমরা কাটিয়ে দিতে পারিনা। এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের বেঁচে থাকায় অনেকরকম উদযাপন দরকার হয়৷ শোক মাথায় রাখলে সেটা সম্ভব নয়। যেসব অনুষ্ঠান কারো শোকে এক মিনিট নিরবতা দিয়ে শুরু হয়, এগুলোর অনেকগুলো আমি শেষ হয়ে দেখেছি নৃত্য সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। এটাই স্বাভাবিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাই, শোকের উপলক্ষ হওয়ার কি দরকার! জীবন অনেক সুন্দর না, অনেক খারাপও না। যখন যে রকম। খরস্রোতা নদীও বছরের একটা সময় শুকিয়ে যায়, অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। আবার সময় এলে সেই নদীতেই প্লাবন হয়। সেই সময়ের অপেক্ষা করতে হবে বলি না, শুধু শুকিয়ে যাওয়া শুষ্ক মরুর মতো প্রাণহীন সময়টা পার করে দিতে বলি। বাকিটা পরে দেখা যাবে....